সমাজবিজ্ঞানের সাথে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক – নৃবিজ্ঞান বা নৃতত্ত্ব ব্যক্তি মানব, তার অবয়বের ঘটনা, বিভিন্ন প্রজাতির জাতিরূপ ও তাদের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে থাকে। নৃতত্ত্বের প্রধান দু’টি শাখা রয়েছে। নৃতত্ত্বের যে শাখা জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে অধ্যয়ন করে তাকে বলা হয় অবয়বিক নৃতত্ত্ব বা ভৌত নৃতত্ত্ব। নৃতত্ত্বের যে শাখা প্রাচীন মানব সংস্কৃতির সৃষ্টিকাল থেকে তার বিভিন্ন স্তর নির্ণয়ের মাধ্যমে গবেষণা ও পর্যালোচনা করে তাকে বলা হয় সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব।
সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের কতকগুলো উপশাখা রয়েছে; যেমন— প্রত্নতত্ত্ব (Archaeology), মানবজাতিতত্ত্ব (Ethnology) ও ভাষাতত্ত্ব (Linguistics)। কাজেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে, সমাজবিজ্ঞানের ন্যায় নৃতত্ত্বের বিষয়বস্তুও অত্যন্ত ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। নৃতত্ত্বের যে শাখা মানুষের আদি ইতিহাস ও তার সংস্কৃতি নিয়ে অধ্যয়ন করে সে শাখার সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা জানি যে, সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো সামাজিক মানব। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের জীবন চর্চার মধ্যে সামাজিক মানুষের প্রকৃতি, আচার ব্যবহার, জীবনধারণ প্রণালী, এমনকি সামাজিক সংগঠন সম্পর্কেও অনেক তথ্য জানা যায়। এক্ষেত্রে নৃতত্ত্বের সাথে সমাজবিজ্ঞানের একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক এফ. এন. হাউজের (F. N. House) উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি মনে করেন যে, একজন সমাজবিজ্ঞানীর নিকট নৃতত্ত্বের প্রধান তাৎপর্য হলো এই যে, নৃতত্ত্ব বর্তমান সমাজের সাথে অতীত সমাজের তুলনামূলক আলোচনার জন্য নানাবিধ তথ্য ও বিষয়বস্তু দিয়ে সাহায্য করে। তিনি বিশেষ জোর দিয়ে বলেন যে, সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী উভয় মহলের কাছে দু’টি প্রশ্নই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত, সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রণালী কি? দ্বিতীয়ত, কিরূপে সাংস্কৃতিক প্রলক্ষণগুলো এক সামাজিক গোষ্ঠী থেকে অন্য সামাজিক গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করে। সেজন্য অনেকে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানকে একই বিদ্যার দু’টি আঙ্গিক বলে মনে করেন; যেমন- সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো সমাজ। অপরপক্ষে, নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো মানব। যেহেতু মানবকে নিয়েই সমাজ সেহেতু নবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত।
কিন্তু উপরিউক্ত সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সমাজবিজ্ঞানের সাথে নৃবিজ্ঞানের একটা প্রভেদ স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়, যেমন- নৃবিজ্ঞানিগণ আদি মানব সংস্কৃতি ও নিরক্ষর মানবসমাসের আলোচনার মধ্যেই তাদের গবেষণা সীমাবদ্ধ রেখেছেন। সেজন মুবিজ্ঞানিগণ গোটা সমাজকেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করেন।
অপরপক্ষে, সমাজবিজ্ঞানিগণ সুসভ্য সমাজের বিভিন্ন অংশ বা দিক; যেমন- পরিবার, সামাজিক পরিবর্তন, সামাজিক সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। এর কারণ বর্তমান সমাজজীবন এতো জটিল যার ফলে গোটা সমাজ অধ্যয়নে এক একটি বিশেষ দিক অধ্যয়ন ব্যতীত গোটা সমাজকে জানা সম্ভবপর নয় ।
নৃতত্ত্ববিদগণ গোটা সমাজকে অধ্যয়ন করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানিগণকে সমাজের এক একটা বিশেষ দিক অধ্যয়নে পরিসংখ্যান ও প্রশ্নমালার উপর বিশেষ নির্ভরশীল হতে হয়। কারণ নৃতত্ত্ববিদগণ ছোট ছোট সম্প্রদায় বা মানবগোষ্ঠীর মাঝেই তাদের গবেষণাকার্য সীমাবদ্ধ রাখেন। অপরপক্ষে, সমাজবিজ্ঞানিগণ বৃহত্তম সমাজের মাঝে তাদের গবেষণাকার্য করে থাকেন।
বর্তমানে অনেকে মনে করে যে, অদূর ভবিষ্যতে যখন নিরক্ষর মানবসমাজ সভ্যতার পর্যায়ে এসে পৌঁছবে তখন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের এ দূরত্ব অনেকাংশেই ঘুচে যাবে।
অন্যান্য লেখা:
সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে? সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ আলোচনা
সমাজবিজ্ঞান একটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান ব্যাখ্যা