জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষ যে শুধু নিজেকে জানার চেষ্টাই করেছে তা নয়। নিজের পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য সে সমানভাবে প্রয়াস চালিয়েছে। তার সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কটি হলো মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সংক্রান্ত বিষয় এবং এটি ভৌত বিজ্ঞানেরই অন্তর্ভূক্ত। এসব বিষয়ের সঙ্গে গভীরভাবে সম্বন্ধযুক্ত হয়েই সমাজবিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্ব গড়ে উঠেছে।
কোন একটি বিষয় অনুশীলনের প্রাক্কালে তার গভীরে মনোনিবেশ করার পূর্বে বিষয়টি সম্পর্কে একটি সাধারণ জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। এ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যেই আমরা এখানে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ‘সমাজবিজ্ঞান’ সম্পর্কিত ধারণা এবং এর উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে ?
সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে বা সমাজবিজ্ঞান কি নিয়ে আলোচনা করে? এ আলোচনার বিষয়বস্তু ও তার সীমাবদ্ধতা কতটুকু? এসব প্রশ্ন নিয়ে বর্তমানকালেও আলোচনা অব্যহত রয়েছে। বস্তুত কোন প্রধান বিষয়টি সঠিকভাবে সর্বপ্রথম আলোচিত হয়েছিল তা কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। একটি মানুষের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ প্রবন্ধ হিসেবে তা কখনোই দেখা দেয় না। প্রকৃতপক্ষে, বিভিন্ন দিকের আলোচনা একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে একত্রিত হয়ে উঠে এবং সেই বিষয়টির বিশেষ নামকরণ করা হয়। সমাজবিজ্ঞান বিষয়টিও এভাবে গড়ে উঠেছে।
সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে তা বলতে গেলে এক কথায় উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় এ বিজ্ঞানেরও রয়েছে বিশেষ সংজ্ঞা। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যে সমাজবিজ্ঞান পূর্ণাঙ্গ সমাজজীবন পর্যালোচনা করে তাকে এককথায় ব্যাখ্যা করাও সম্ভব নয়। তাই আমরা সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যেও সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ দেখতে পাই।
আধুুনিক সমাজবিজ্ঞানের নানাবিধ বিশ্লেষণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপাদানের প্রাচুর্যহেতু সমাজবিজ্ঞানের অনেক সংস্কার হয়েছে। নিম্নে সমাজবিজ্ঞানীদের কয়েকটি সংজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান কি তা তুলে ধরা হলো-
ক) সমাজবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কলিন এইচ. গিডিংস (Franklin H. Giddings) তাঁর `Principles of Sociology’ গ্রন্থে বলেন, “সমাজবিজ্ঞান মানুষের মানসিক সংযোগের বিজ্ঞান।” (Sociology is the science of the association of human minds.)। গিডিংস এ সংজ্ঞা দ্বারা বলতে চেয়েছেন, সামাজিক বিজ্ঞানগুলো সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত এবং সমাজবিজ্ঞান তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। (Sociology is the inclusive and coordinating only as it is fundamental social science.)।
খ) সমাজবিজ্ঞানী মরিস জিন্সবার্গ ব্যাপকতর অর্থে মানবিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ও সম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তাঁর ‘Sociology’ নামক গ্রন্থে বলেন, “সমাজবিজ্ঞানে মানব সমাজের পারস্পরিক ক্রিয়া ও পারস্পরিক সম্পর্ক এবং এর অবস্থা ও পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।” (In the broader sense, sociology is the study of human instructions and in the relations, their condition and consequence.)
গ) সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকইভার সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সামাজিক সম্পর্কের উপর জোর দিয়ে বলেন, “সমাজবিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান যা সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঠ দান করে। (Sociology alone studies social relationships themselves and society itself.) ম্যাকাইভার সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সামাজিক সম্পর্কের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর প্রদত্ত সংজ্ঞার মাধ্যমে এ ধারণা সুস্পষ্ট যে সমাজবিজ্ঞানের অনুশীলনের বস্তু হলো মানুষের সামাজিক সম্পর্কের সামগ্রিক রূপ।
আরও পড়ুন: সামাজিক স্তরবিন্যাস কি? সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য
সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ
উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে বিকাশ লাভ করেনি। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় জ্ঞানের একটি পৃথক শাখা হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের পরিচয় বেশি দিনের নয়।
প্রকৃতিকে মানুষ যত সহজভাবে জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে ঠিক তেমনি সহজাত প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মানুষ জানতে চেয়েছে তার সমাজকে। তার এ অনুসন্ধানের যেন শেষ নেই। এ অনুসন্ধানের ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা সর্বপ্রথম দর্শন শাস্ত্রকে পাই। প্রাচীনকালে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল ও পিথাগোরাস প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানকে দর্শন শাস্ত্রের আওতাভুক্ত মনে করতেন। দর্শন শাস্ত্রের অঙ্গ হিসেবেই তাঁরা সামাজিক বিজ্ঞানকে পর্যালোচনা করেন। আর দর্শন শাস্ত্র যেন বেশ সার্থকতার সাথেই সর্বপ্রকার অনুসন্ধানকে আপন আলিঙ্গনের মাঝে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রাচীন গ্রিক ও রোমে মানবচিন্তা বিভিন্ন প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করে। জগৎ ও জীবনের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে প্রাচীন চিন্তাবিদগণ সমাজাতাত্ত্বিক বা সমাজবিজ্ঞানের দিকদর্শনের সন্ধান লাভ করেন।
প্রাচীন গ্রিক ও রোম পণ্ডিতদের লেখায় সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনা সমৃদ্ধি লাভ করে। তবে তাদের লেখায় সামাজিক সম্পর্কসমূহের আলোচনা যেমন রাজনৈতিক বিষয়াদির দ্বারা প্রভাবিত ছিল তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনা পৃথকভাবে করা হয় নি। তবুও তাদের প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য ছিল এক আদর্শ সমাজজীবনের আলোচনা। যেমন দার্শনিক প্লেটোর ‘দি রিপাবলিক’ গ্রন্থে বিভিন্ন সামাজিক সমস্য ও প্রশ্নের পর্যালোচনা দেখা যায়। এরিস্টটলের ‘দি পলিটিক্স’ ও ‘দি এথিক্স’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম আইন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে সুসংবদ্ধ আলোচনা পাওয়া যায়। রোমান দার্শনিক সিসেরো তাঁর গ্রন্থ ‘De Offices‘ এ দর্শন, রাজনীতি, আইন, সমাজবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে গ্রিক চিন্তার ফসলগুলো পাশ্চাত্য জগৎকে প্রদান করেছেন। তবে তাঁর এ আলোচনায় মূলত আইন বিষয়ক বিষয়গুলোর প্রাধান্য ছিল এবং তাদের জ্ঞান চর্চা ইউরোপকে মূলত আইন বিষয়ক জ্ঞান বিকাশে সমৃদ্ধ করেছেন।
প্লেটো ও এরিস্টটলের সময় থেকে আধুনিক যুগের শুরু পর্যন্ত দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রাক-বৈজ্ঞানিক ধরনের সমাজচিন্তায় বিশেষ কান অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় না। মধ্যযুগের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সমাজচিন্তায় যেসব অবদান লক্ষ্য করা যায় সেসব বেশিরভাগই খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠান চার্চ বা গির্জার পুরোহিততান্ত্রিক চিন্তাধারা, যা পৃথিবীর মানুষ সম্বন্ধে অতীন্দ্রিয় ধ্যানধারণার প্রতিফলন ঘটে।
১৫১৩ সালে ম্যাকিয়াভেলীর ‘দি প্রিন্স’ (The Prince) প্রকাশিত হয়। ম্যাকিয়াভেলী অত্যন্ত তীক্ষ্ণতার সাথে শাসকের যোগ্যতা এবং শাসক হিসেবে করণীয় বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করেন এবং সেই সাথে রাষ্ট্র সংক্রান্ত তত্ত্ব প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক দর্শনের আলোচনায় ঝড় তোলে।
ম্যাকিয়াভেলীর সমসাময়িক টমাস মূর ১৫১৫ সালে প্রকাশিত তাঁর সুবিখ্যাত ‘ইউটোপিয়া’ গ্রন্থে অত্যন্ত বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে তৎকালীন সমাজের দোষত্রুটিগুলোর উল্লেখ করেন। টমাস মূর এর কল্পিত সমাজ যে তখন গড়ে উঠা সম্ভব নয়, সে সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন এবং এজন্যই তিনি ‘ইউটোপিয়া’ নামকরণ করে বস্তুত কাল্পনিক বলে অভিহিত করেন। তবে তাঁর শোষণবিহীন কাল্পনিক সমাজব্যবস্থার ধারণা পরবর্তীকালে সমাজবাদী চিন্তাধারায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালির জামবাতিস্তা ভিকু তাঁর ‘দি নিউ সায়েন্স’ পুস্তকে ‘মানবেতিহাসের বিজ্ঞান’ নামক একটি বিষয়ের অবতারণা করেন। সমাজ কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীন। বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ও পাঠের মাধ্যমে সমাজ বিকাশের সূত্রাবলি আবিষ্কার করা যায়। তিনি উল্লেখ করেন সমাজ িএকটি নির্দিষ্ট নিয়মে বিবর্তিত হয়। তিনি সমাজ বিকাশের ধারাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেন। যথা-
১) Age of God (দেবতাদের যুগ),
২) Age of Hero (বীরত্বের যুগ) এবং
৩) Age of Man (মানুষের যুগ)।
ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তাঁর ‘দি স্পিরিট অব ল’ ‘The Spirit of Law’ নামক গ্রন্থে মানবসমাজের উপর জলবায়ু ও অন্যান্য বাহ্যিক উপাদানের প্রভাব প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।
ভিকু ও মন্টেস্কু ছাড়া কঁদরসে ও সেন্ট সিঁমন নামে আরো দু’জন পণ্ডিত রয়েছেন যারা সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কঁদরসে তাঁর ‘হিস্টরিক্যাল স্কেচ অব দি প্রগ্রেস অব দি হিউম্যান মাইন্ড’ নামক গ্রন্থে সমাজ পরিবর্তনের একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে সমাজতাত্ত্বিক মতবাদের বিকাশে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল।
সেন্ট সিঁমন মূলত কল্পনাবিলাসী সংস্কারক। তাঁর মতে, বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ ছাড়া সামাজিক সংস্কার সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন:
নগর সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে? নগর সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
অগাস্ট কোঁৎ পূর্ববর্তীকালে মন্টেস্কু, কঁদরসে, হার্ডার, এডাম স্মিথ, ভিকুকেই অনুসরণ করেছিলেন।
প্রাচীনকালে পাশ্চাত্যের মতো প্রাচ্যেও কৌটিল্যের বা চানক্যের অর্থশাস্ত্রে অনুরূপ আলোচনার প্রয়াস খুঁজে পাওয়া যায়।
মধ্যযুগে ইবনে খালদুন সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছেন। তিনিই প্রথম ঐতিহাসিক দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল মুকাদ্দমা’তে সমাজের গতিবিধি, সমাজজীবনে বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের ব্যাখ্যা দেন। তিনি সামাজিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ‘উমরানিয়াত’ এর গূঢ় তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি উমরানিয়াতকেই ‘আধুনিক সমাজবিজ্ঞান’ হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তৎকালীন সময়ে সমাজ বিষয়ক তাঁর এ ধরনের দূরদর্শী চিন্তাভাবনার জন্য অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মধ্যে এ ব্যাপারে গভীর মতৈক্য রয়েছে যে, সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃত আদি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইবনে খালদুন।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মধ্যযুগের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারা অন্তর্দৃষ্টির দিক থেকে মোটেই সমৃদ্ধ নয়। কারণ ধর্মীয় প্রভাব ও রক্ষণশীল মনোভাবের দরুন সামাজিক উন্নতি সাধনে শক্তি ক্ষয় অনাবশ্যক বলে গণ্য করা হতো। ফলে সমাজবিজ্ঞান বিকাশের ফলে মন্থর গতি লক্ষ্য করা যায় এবং মধ্যযুগের ইহজাগতিক সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তাতে সমাজবিজ্ঞানে জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্র অনুৎপাদক বলে অভিহিত।
পঞ্চদশ থেকে ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয় সমাজজীবনে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হওয়ায় সেখানকার সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক রূপটাও বিজ্ঞানের অবদানে আলোকিত হয়। বস্তুতপক্ষে এ পরিবেশেই সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে।