সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
মানুষ সামাজিক জীব। আদিমকাল থেকে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন করে আসছে। এরিস্টটল তাঁর গ্রন্থ ‘Politics’ এ বলেছেন, “মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব এবং যে লোক সমাজের সভ্য নয়, সে হয় দেবতা, না হয় পশু।” এ উক্তির স্পষ্ট বিশ্লেষণ হলো মানুষ সমাজে জন্ম নেয় এবং সে সমাজে জীবন অতিবাহিত করে।
ম্যাকাইভার ও পেজ বলেন, “নিরাপত্তা, সুখ, পুষ্টি, শিক্ষা, উপকরণ, সুযোগ এবং সমাজের দেওয়া আরো বহু পরিচর্যার জন্য মানুষ সমাজের উপর নির্ভরশীল। সে তার চিন্তার উপাদানের জন্য, তার স্বপ্নের জন্য, আকাঙ্ক্ষার জন্য এমনকি তার শারীরিক ও মানসিক ব্যাধির জন্য সমাজের উপর নির্ভরশীল। সমাজে তার জন্মগ্রহণই সমাজের একান্ত প্রয়োজনীয়তার কথা সূচিত করে। “১
শুধু তাই নয়, জীবন রক্ষার প্রয়োজনে মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন করতে বাধ্য করে। জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহের জন্য সমাজ গঠন অত্যাবশ্যক। মানুষ জীবনের প্রতিটি স্তরে সমাজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
নারী নির্যাতনের প্রভাব আলোচনা কর |
প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদ জগতের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, উদ্ভিদ তার বংশ বৃদ্ধি করে এবং সংঘবদ্ধভাবে বেড়ে উঠে। আবার প্রাণীদের প্রাণীসুলভ বৈশিষ্ট্যের জন্যও সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের প্রয়োজন হয়। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের জন্য প্রাণীরা সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করে। তেমনি মানুষও নিঃসহায় হয়ে জীবন কাটাতে পারে না। এছাড়াও মানবজীবনে রয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ; ঋতুচক্রের আবর্তনে কখনো শীত, কখনো গ্রীষ্মের প্রখরতা, আবার কখনো প্লাবন। এসবকে জয় করার উদ্দেশ্যেই মানুষ সমাজের সৃষ্টি করেছে।
আদিকালে মানুষ ছিল অসহায়। জীবনের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে টিকে থাকা ছিল কল্পনাতীত। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে একক জীবন বাঁচাতে পারে না। মানুষ উপলব্ধি করলো অপরের সংঘবদ্ধতা। এসব কারণে স্বাভাবিকভাবে মানুষকে জন্মাবধিই সামাজিক হতে বাধ্য করেছে। সমাজের বাইরে আদর্শ ও উন্নত জীবনযাপন সম্ভবপর নয়। বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষার উন্নত চিন্তা দ্বারাই প্রস্ফুটিত হতে পারে। এ চিন্তাশক্তি দ্বারাই মানুষের সঙ্গে মানুষের সহযোগিতা সুদৃঢ় হয়েছে।
সংক্ষেপে বলা চলে, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির সন্তুষ্টির জন্য আবশ্যকীয় বস্তু সংগ্রহের প্রয়োজনে, জীবনের নিশ্চয়তার জন্য, শিক্ষা ও নৈতিক উন্নতিকল্পে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ স্বাভাবিকভাবে সামাজিক জীবনযাপন করে। আদিকালেও সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তা ছিল; বর্তমানে তার প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়ে চলেছে।
প্রয়োজন যত বেড়েছে তার সাথে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা আরো বেড়ে গিয়েছে। বর্তমানে মানুষ পূর্বের ন্যায় শুধু দলগতভাবে বাঁচতে চায় না। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তার সাথে সাথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে।
এছাড়াও বর্তমান জগতে সর্বস্থানের অবস্থা এক নয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের কাঠামোরও পরিবর্তন হচ্ছে। তাই কোথাও দেখা যাচ্ছে কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠেছে, আবার কোথাও শিল্পোন্নত সমাজ গড়ে উঠেছে। এতদিন মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে সমাজ গঠন করেছে- আজ সে সমাজকে জানার জন্য সমাজের মানুষ প্রয়োজনবোধ করছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মূল বিষয়বস্তু হলো সমাজকে পূর্ণাঙ্গভাবে জানা। এজন্য তাঁদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান শব্দ হচ্ছে সমাজ। একথা আজ কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবে না যে কোথায়, কোন দিন সমাজের উৎপত্তি হয়েছে। তবে কিভাবে সমাজের উৎপত্তি হয়েছে তা নির্ধারণ করার প্রয়াস সমাজবিজ্ঞানিগণ করেছেন এবং সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানিগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন।
সমাজজীবনের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে এবং যুগে যুগে বিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের রূপ কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা আলোচনাসাপেক্ষ। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানিগণ অনুমান করেন যে, মানবজাতির সৃষ্টি থেকেই সমাজজীবন শুরু হয়েছে। মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব- এ সত্যের উপর ভিত্তি করে সমাজবিজ্ঞানিগণ এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
মানবসমাজের উৎপত্তির কথা আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, আদিকাল থেকেই সমাজের কথা উল্লেখ রয়েছে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটল থেকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানিগণ সকলেই মনে করেন, সমাজের উৎপত্তির কারণ সামাজিক মানুষ।
মানবসমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের কারণ খুঁজতে গিয়ে কয়েকজন ইতালিয়ান সমাজবিজ্ঞানী মত পোষণ করেন যে, মানুষ সর্বপ্রথম দলবদ্ধভাবে বাস করতো। পরে সামাজিক মানুষের মাঝে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী মন্টেস্কু মনে করেন, প্রকৃতির ভয়ে মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে বসবাস আরম্ভ করে এবং পরে সমাজ গঠিত হয়।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধের উপায় গুলো কি কি? |
প্রখ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কোঁৎ, যাকে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়, তিনি মনে করেন যে, সমাজ একদিনের সৃষ্ট নয়- বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে সমাজের রূপ নতুনত্ব লাভ করছে। তিনি তাঁর ‘Course de Philosophy’ তে দেখিয়েছেন যে, সমাজ তিনটি স্তর ভেদ করে পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে। আবার অনেক সমাজবিজ্ঞানী সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের কারণ খুঁজতে গিয়ে ডারউইনের ‘বিবর্তন মতবাদ’কে সমর্থন করেছেন। বিশেষ করে, সমাজবিজ্ঞানী স্পেনসার, মরগান ও টেলরের বিশ্লেষণ মতে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা প্রত্যেকেই এ মতবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন।
স্পেনসার মনে করেন যে, সমাজের সংগঠন অসামঞ্জস্য থেকে সামঞ্জস্যতার মধ্যে, জটিলতার মধ্য থেকে শৃঙ্খলতার মধ্যে ক্রমান্বয়ে আসছে- যার মধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিরাজমান রয়েছে এবং তাদের একটির সাথে অপরটি স্থায়ীভাবে সংযুক্ত। অসামঞ্জস্য ও জটিলতার মধ্য থেকে সামঞ্জস্য ও শৃঙ্খলতার যে ধারণা জেগেছে, তা হচ্ছে একতা ও নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজন। এজন্য মানুষ একটি বিশেষ সীমারেখার মাধ্যমে কল্পিত ধারণার সৃষ্টি করেছে এবং সে ধারণার বাস্তবায়ন হচ্ছে সমাজ। প্রকৃতপক্ষে স্পেনসার মনে করেন যে, সমাজ হচ্ছে একটি কল্পিত ধারণা, যার মাঝে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিরাজমান এবং ঐগুলোর একটির সাথে অপরটি স্থায়ীভাবে সংযুক্ত।
মরগান সমাজের কয়েকটি স্তরকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এদের প্রায় সকলেই সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা করতে গিয়ে সমাজের বিকাশের কথা বলেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের ধারণা থেকে আমরা এ মত পোষণ করতে পারি যে, মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে প্রয়োজনের তাগিদে সমাজ সৃষ্টি করতে বদ্ধপরিকর। সেজন্যই আমরা বিশেষভাবে কোন সমাজের উৎপত্তি ও কারণ নিয়ে মত পোষণ করতে পারি না। সমাজের উৎপত্তি হঠাৎ করে হয় নি- ক্রমান্বয়ে মানুষের বুদ্ধি ও জ্ঞানবিকাশের সাথে সাথে সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ হয়েছে। সেজন্য সমাজের উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস উদ্ঘাটন করা দুষ্কর।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানতে পারলেন।
1 comment
[…] সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর […]
Comments are closed.