সমাজ কাঠামো
সমাজবিজ্ঞানে ‘সমাজ কাঠামো’ একটি মৌল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রত্যেক জিনিসেরই একটি কাঠামো থাকে যার উপর ভিত্তি করে ঐ বিষয়টি টিকে থাকে। ঠিক তেমনি সমাজেরও একটি কাঠামো রয়েছে যা গঠিত হয় সমাজস্থ কিছু উপাদানের সমন্বয়ে। কাঠামো শব্দটি চার্লস ডারউইন জীববিজ্ঞানে প্রথম ব্যবহার করেন। আর সমাজ কাঠামো প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন দ্য টকভিল (১৮০৫-১৮৫৯) ১৮৩৫ সালে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে এ প্রত্যয়টির প্রথম অবতারণা করেন সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ হার্বার্ট স্পেন্সার। পরবর্তীকালে স্পেন্সারকে অনুসরণ করে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম এবং ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী রেডক্লীফ ব্রাউন সমাজকাঠামো নিয়ে ব্যাপকতর আলোচনা করেন এবং এ প্রত্যয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় নেডেল, মরিস জিন্সবার্গ, লিচু, ম্যাকাইভার, টি. বি. বটোমোর প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীও সমাজ কাঠামো নিয়ে আলোকপাত করেন। এভাবে বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিকদের অবদানে সিক্ত হয়ে সমাজকাঠামো প্রত্যয়টি বিভিন্ন সুসংবদ্ধ সামাজিক প্রপঞ্চের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে থাকে।
আরও পড়ুন:
উপসংস্কৃতি কি? বিপরীত সংস্কৃতি বলতে কি বুঝ?
বস্তুগত সংস্কৃতি কি? অবস্তুগত সংস্কৃতি কি?
সমাজ কাঠামোর সংজ্ঞা
Structure শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Structura’ থেকে এসেছে যার আভিধানিক অর্থ হলো গঠন করা বা তৈরি করা। Karl Manheim (কার্ল ম্যানহাইম) ‘Social Structure’ বা সমাজকাঠামোকে ‘Structure of Action’ বা কার্মিক গঠন বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এ কার্মিক সংযোগের কারণে সামাজিক গোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মসূচি সম্পাদনে পরস্পরের সাথে জড়িত। বস্তুত তিনি যা বলতে চান তা হলো প্রতিটি সংগঠনই একটি ‘Action Structure’ বা কার্মিক সংস্থা; এর সাথে একটি গোষ্ঠী জড়িত এবং এর সদস্যরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে কর্মসূত্রে আবদ্ধ।
সামাজিক নৃবিজ্ঞানী র্যাডক্লিফ ব্রাউন (Radcliffe Brown) তাঁর ‘On Social Structure’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “ব্যক্তির পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক সমাজকাঠামোর একটি অংশ। বস্তুতপক্ষে, যাকে আমরা সমাজ কাঠামো বলে থাকি তা হচ্ছে একটি বিশেষ সময়ে বিশেষ ব্যক্তির সম্পর্ক। “১
অমার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে সমাজকাঠামোর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন মরিস জিন্সবার্গ (Morris Ginsberg). তিনি তাঁর ‘Reason and Unreason in Society’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, “The study of social structure is concerned with the principal forms of social organizations i.e. types of groups, associations and institutions and the complex of these which constitute societies.” অর্থাৎ, সমাজ কাঠামো হচ্ছে কতকগুলো প্রধান দলের বা প্রতিষ্ঠানের জটিল সম্পর্ক, যার দ্বারা সমাজ গঠিত হয়।
ম্যাকাইভার ও পেজ (MacIver and Page) তাঁদের ‘Society’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “In the analysis of social structure the role of the diverse attitudes and interests of social beings ngs is revealed.” অর্থাৎ, সমাজ কাঠামো হলো সমাজস্থ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর পারস্পরিক স্বার্থ ও মনোভাবের সাথে সম্পর্কযুক্ত ভূমিকার এক অনন্য রূপ।
আবার অনেকে সমাজকাঠামোকে বিশ্লেষণ করেছেন ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে। এ মতবাদ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে এস. এফ. নেডেল (S. F. Nadel) এর গ্রন্থ ‘The Theory of Social Structure’ এবং H. Gerth ও W. Mills এর লিখিত ‘Character and Social Structure’ গ্রন্থে।
সামাজিক নৃবিজ্ঞানী এস. এফ. নেডেল (S. F. Nadel) সমাজকাঠামোর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “We arrive at the structure of a society through abstracting from the concrete population and its behaviour the pattern or network (or system) of relationships obtaining between actors in their capacity of playing roles relative to one another.” অর্থাৎ, নেডেলের মতানুযায়ী বলা যায়, ব্যক্তির নির্দিষ্ট ভূমিকার ব্যবস্থার মাঝে সমাজকাঠামোকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিটি সমাজে ব্যক্তি কতকগুলো ভূমিকা পালন করে থাকে এবং তাদের ভূমিকার বাস্তব রূপ থেকে সমাজকাঠামোকে পাওয়া যায়।
এইচ. গার্থ ও সি. রাইক মিলস্ (H. Girth and C. Wright Mills) সমাজকাঠামোকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন, “The concept of role is the key term in our definition of institution and just as role is the unit with which we build the conception of institution, so institution is the unit with which we build the conception of social structure.”” অর্থাৎ, তারা মনে করেন যে, প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তির ভূমিকা সবচেয়ে মূল্যবান এবং ব্যক্তির ভূমিকার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। সে কারণে প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমাজকাঠামো নিহিত আছে।
আর. কে. মার্টন (R. K. Merton) মনে করেন, সমাজের মূল এককগুলো; যথা: পরিবার, দল বা গোষ্ঠী ও জাতি সব মিলে সমাজ গঠিত হয়। তাঁর মতে, এগুলোই হলো সমাজকাঠামোর অঙ্গ যার সমন্বয়ে সমাজ গঠিত।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞা ও আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, সামাজিক গঠনই হলো সমাজকাঠামো। সমাজ কাঠামো হলো কতকগুলো সংগঠনের পারস্পরিক সূত্রের সমন্বয়। যোগসূত্রগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্ম ও পরিবার দ্বারা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। বস্তুত সমাজকাঠামো বিশেষ কোন বস্তু নয়, তাহলো সামাজিক কার্যবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশেষ একটি ব্যবস্থা, যার সামাজিক বন্ধন অটুট থাকে।