সম্পত্তি কত প্রকার তা কিভাবে নির্ণয় করা যায়? সাধারণভাবে এর জবাব খুঁজতে – গেলে সম্পত্তির বিপুল ধারার দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হয়। কারণ সভ্যতা সৃষ্টির সাথে সাথে সমাজে সম্পত্তির এতো বিপুল ধারায় প্রকাশ ঘটেছে যে, মানুষ নিজের সৃষ্টির সামনে নিজেই হিমসিম খেয়ে যায়।
সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানিগণ সম্পত্তি ধারণার প্রেরণা সম্পর্কে জানতে গিয়ে মানবসমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে এর বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী ড. এ. কে. নাজমুল করিম তাঁর ‘সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণ’ গ্রন্থে বিভিন্ন প্রকার সম্পত্তির একটি ছক তুলে ধরেছেন; যেমন-
১. জমি- শিকার বা ফলমূল সংগ্রহের যুগ, যাযাবর যুগ, কৃষি যুগ,
২. অস্থাবর,
৩. মন্ত্রতন্ত্র ইত্যাদির উপর অধিকার,
৪. দাস।
সম্পত্তির উপর্যুক্ত ছক বিভিন্ন সমাজের প্রেক্ষাপটে দেখানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক অবস্থায় জীবিকা অর্জনের হাতিয়ার ও জীবন সম্পৃক্ত ধ্যানধারণা লাভ করে পার্থিব প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে বিভিন্ন প্রকার বিষয় ও বস্তুকে উপযোগ হিসেবে গুরুত্ব আরোপ করে বিভিন্ন প্রকার সম্পত্তির ধারণা লাভ করেছে।
সম্পত্তি কাকে বলে | সম্পত্তির সংজ্ঞা |
মানুষের আদিম সম্পত্তি হলো তার আহার্য বস্তু। এটাই ছিল তার একমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিস। তখন ছিল মানুষের খাদ্য সংগ্রহ অবস্থা।
জমি চাষ শুরু হওয়া থেকে মানুষ এ জ্ঞান লাভ করলো যে, পৃথিবী পৃষ্ঠ একটা বিরাট সম্পত্তির উৎস। তারপর প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে। এ বিপ্লব হলো কৃষি কাজের প্রবর্তন। কৃষি বলতে আমরা বুঝি হো-কালচার বা নিড়ানী কৃষি থেকে কাঠের লাঙল দিয়ে জমি চাষ ও প্রযুক্তিবিদ্যার অবস্থা পর্যন্ত। পশুপালন একটি কৃত্রিম প্রক্রিয়া। পশুপালনের জন্য প্রয়োজন ছিল তৃণভূমি।
নির্দিষ্ট সময়ে পশুদের খাদ্য তৃণভূমির তৃণলতা ফুরিয়ে গেলে নতুন তৃণভূমির সন্ধানে বের হতে হতো। শিকার ও পশুপালনের প্রাথমিক অবস্থায় মানুষকে তাই যাযাবর জীবনযাপন করতে হতো। তখন জীবিকার সন্ধানে যেসব উপকরণ প্রয়োজন ছিল তাই তাদের সম্পত্তি বলে গণ্য হতো। শিকারী জীবনে পশুপাখি ও পশুপাখির চামড়া, পালক, মাংস, দুধ ইত্যাদি ছিল সম্পদ। কৃষিকার্য আয়ত্ত করার পর জমিজমার উপর গুরুত্ব আরোপ হওয়ার পর জমিই হলো সম্পত্তি।
যে অঞ্চলে কৃষিকাজ বা পশুপালন পদ্ধতি অসম্ভব, সে অঞ্চলে বাস করে এস্কিমো বা অস্ট্রেলীয় উপজাতির পক্ষে পশুপালন বা কৃষিকাজের সুবিধা ভোগ করা সম্ভব নয়। এস্কিমোদের সংস্কৃতির উপর পারিপার্শ্বিক জলবায়ু ও বাস্তুসংস্থানের প্রবল ছাপ পড়েছে। যে সামান্য ক’টি জীবজন্তু শিকার হিসেবে পাওয়া যায়, সেগুলোই তাদের জীবিকার সম্বল এবং তা থেকেই এস্কিমোরা হাতিয়ার ও পরিধেয় সংগ্রহ করে এবং তাই তাদের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচ্য।
আদিবাসীদের এরূপ বিচিত্র জীবন ব্যবস্থায় আরো লক্ষণীয় যে, তার নাম, প্রতীক, মন্ত্রতন্ত্র, যাদুবিদ্যা, ধর্মীয় গোপন রহস্য একান্তই নিজস্ব সম্পত্তি।
দুর্বলদেহী মানবজাতি বুদ্ধির জোরে প্রতিকূল পৃথিবীতে বেঁচে আছে এবং বুদ্ধি খাটিয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রয়োজনীয় উপায়গুলোই হলো মানুষের সম্পত্তি। সেজন্য কার্ল মার্কস মানুষকে ‘হাতিয়ার প্রস্তুতকারী প্রাণী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মানবজাতির সংস্কৃতি বিকাশে বিভিন্ন প্রকার হাতিয়ার উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রকার সম্পত্তির ধারণা ও প্রকারভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি, সমাজ বিকাশের এক • পর্যায়ে ‘হাতিয়ার প্রস্তুতকারী প্রাণী’ নিজেই ‘জীবন্ত সম্পত্তি’ হিসেবে গণ্য হয়েছে। মনীষী এরিস্টটল দাসকে জীবন্ত সম্পত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আধুনিক যান্ত্রিক যুগে দৈহিক শ্রম ও গোপন রহস্যের মন্ত্রের বেড়াজালকে প্রাচীনতম সমাজের প্রেক্ষাপটের ন্যায় সম্পত্তি হিসেবে ততটা গুরুত্ব আরোপ করে না। মানুষের ধ্যানধারণা, ধর্মদর্শন, জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প, কলকারখানা সভ্যতার গতিধারায় মূল্যায়িত।
সমাজবিজ্ঞানী ও সামাজিক নৃবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানের ফলে জানা যায় যে, সম্পত্তির প্রকারভেদ বা ধরনের উপর তার মালিকানা নির্ভর করে। সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, জমির মালিকানায় আদি উৎপাদন ব্যবস্থায়, এমনকি পশুপালন ও মৎস্য শিকারের পর্যায়েও নানা ধরনের মালিকানা দেখা যায়; যেমন-
১. গোষ্ঠী বা দল মালিকানা,
২. পারিবারিক মালিকানা,
৩. উচ্চ বংশের পরিবারের মালিকানা,
৪. সামন্ত প্রভুর মালিকানা,
৫. দলপতির মালিকানা ও
৬. ব্যক্তিগত মালিকানা।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা লক্ষ করতে পারি যে, সম্পত্তির মূল প্রয়োজন অর্থনৈতিক হলেও এর উপভোগ সমাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত। সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা দ্বারা সম্পত্তির প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। সেজন্য সম্পত্তির প্রকারভেদ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মালিকানা ও উত্তরাধিকার রীতি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। সামাজিক নৃবিজ্ঞানিগণ তাঁদের গবেষণার ফলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মালিকানা ও উত্তরাধিকার, সম্পত্তির রকম, নমুনা বা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। আবার সম্পত্তির প্রকৃতি নির্ভর করে বিয়ের রীতি, বংশানুক্রম পদ্ধতি, সমাজের গণতান্ত্রিক বা অভিজাততান্ত্রিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর।
মাকর্সীয় ধারণায় বলা হয় সম্পত্তির প্রকৃতি নির্ধারিত হয় উৎপাদন পদ্ধতির দ্বারা। উৎপাদন পদ্ধতিই বিশেষ করে অর্থনৈতিক কাঠামো ও সম্পত্তির প্রকৃতি নির্ণয় করে। মাকর্সীয় ধারণায় সেজন্য আদিম সমাজে সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার অস্তিত্ব নেই বলে উল্লেখ করেন। তাঁদের মতে, আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজজীবনে ‘গোষ্ঠী বা দল মালিকানা’ ছিল।
সুশীল সমাজ কাকে বলে | সুশীল সমাজ কি | সুশীল সমাজ বলতে কি বুঝ |
সম্পত্তি কত প্রকার
সমাজের প্রচলিত প্রথা দ্বারাই নির্ণীত হয় সম্পত্তির ধরন বা প্রকারভেদ। আমরা নিম্নে সম্পত্তি কত প্রকার তথা সম্পত্তির প্রকারভেদ গুলো উল্লেখ করছি।
সমাজে সাধারণত তিন প্রকার সম্পত্তি প্রচলিত; যথা:
ক. সাধারণ সম্পত্তি বা এজমালী সম্পত্তি,
খ. যৌথ সম্পত্তি ও
গ. ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
ক. সাধারণ সম্পত্তি বা এজমালী সম্পত্তি
এ ব্যবস্থায় একাধিক লোকের অধিকার বর্তায় এবং সকলেই তাদের সম্পত্তি সমভাগে ভোগ করতে পারে। সমাজের প্রচলিত প্রথা দ্বারা নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকা, গোষ্ঠী বা দল অথবা সম্প্রদায় সাধারণ সম্পত্তির উপর অধিকার স্থাপন করে।
খ. যৌথ সম্পত্তি
উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সূত্রে অথবা যৌথ অংশীদার বা শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমগুলো হচ্ছে যৌথ সম্পত্তি। যৌথ সংস্থার সম্পত্তির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে; এসব সংস্থার শেয়ার যারা ক্রয় করেছেন তারাই সংস্থার মালিক। কিন্তু সংস্থার আইন স্বীকৃত স্বত্ব থাকায় সংস্থার নামে সম্পত্তি ক্রয়বিক্রয় হয়।
গ. ব্যক্তিগত সম্পত্তি
যেসব বস্তু বা বিষয়ে ব্যক্তিগত ভোগ ও স্বত্ব স্বীকৃত এবং ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ক্রয়বিক্রয় করতে পারে তাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে ব্যক্তিকে সমাজ ও নির্দিষ্ট প্রথা এবং আইন অবশ্যই মেনে চলতে বাধ্য থাকতে হবে।
অতএব বলা যায়, সম্পত্তির শ্রেণিবিভাজন সর্বজনীন নয়। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে সম্পত্তির ধরন লক্ষ করা গেলেও আধুনিক সমাজে এসে তা অধিক সুস্পষ্টতা লাভ করেছে।
1 comment
[…] […]
Comments are closed.