জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের কাজের পরিধি- আওতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যয়ের পরিমাণও বাড়তে থাকে। শুধু করের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে রাষ্ট্র তার প্রয়োজনীয় বিশাল ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। এজন্য তাকে ঋণও গ্রহণ করতে হয়। আজকের ব্লগে জানবো, সরকারি ঋণ কি ও সরকারি ঋণের উদ্দেশ্য সমূহ।
সরকারি ঋণ কি?
সরকারি ঋণ বলতে সরকার বা রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ঋণকে বোঝায়। সরকার তার ব্যয় নির্বাহের জন্য জনগণের নিকট থেকে, ব্যাংক ব্যবস্থার নিকট থেকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট হতে এবং বিদেশি নাগরিক, বন্ধু দেশ, সরকার, সংস্থা, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে যে ঋণ সংগ্রহ করে, তাকেই সরকারি ঋণ বলা হয়।
অনেকে মনে করে, সরকার ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ঋণকেও সরকারি ঋণ বলা যায়। সরকার কোনো সময় Funded Debt গ্রহণ করতে পারে যা মেয়াদহীন। যদি ঋণপত্র গ্রহীতা যখন তখন সুদ উত্তোলন করতে পারে তাকে Floting Debt বলে। এ ধরনের ঋণ ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারে যা এক মাস, তিন মাস বা এক বছরের কম সময়ের জন্য প্রযোজ্য। Unfunded ঋণের মাধ্যমেও সরকার ঋণ গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে ঋণপত্রসমূহ দীর্ঘমেয়াদি এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ব্যক্তি ঋণের অর্থ সুদসহ আদায় করতে পারে। যেমন- বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি যা Unfunded Debt.
সরকারি ব্যয় কি | সরকারি ব্যয়ের খাতসমূহ আলোচনা কর |
অধ্যাপক হিক্স উৎপাদনশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারি ঋণকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। যথা-
(i) মৃতভার ঋণ (Dead Weight Debt): এ ধরনের সরকারি ঋণ দ্বারা দেশের আয়, উৎপাদন, নিয়োগ বা কল্যাণ কিছুই বৃদ্ধি পায় না। যেমন- যুদ্ধ ঋণ-যুদ্ধ ব্যয় নির্বাহের জন্য যে ঋণ গ্রহণ করা হয়।
(ii) নিষ্ক্রিয় ঋণ (Passive Debt): এ ধরনের ঋণ হতে প্রত্যক্ষ আয় সৃষ্টি হয় না, তবে কল্যাণ সৃষ্টি হয়। এ থেকে পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়। যেমন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল স্থাপন, বিনোদন কেন্দ্র, খেলার মাঠ, পাঠাগার স্থাপন প্রভৃতি।
(iii) সক্রিয় ঋণ (Active Debt): এ ধরনের ঋণ হতে দেশের জনগণের আয় বৃদ্ধি পায়, উৎপাদন, নিয়োগ, কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। যেমন: রাস্তাঘাট উন্নয়ন, শিল্প স্থাপন ইত্যাদি।
সরকারি ঋণের উদ্দেশ্য
কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রব্যবস্থা উদ্ভবের পর সরকারি ব্যয়ের আওতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা বিশ্বাস করতেন, সরকারি ব্যয় সবসময়ই অপচয়মূলক। অর্থনীতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্ণনিয়োগ অর্জন হয়। সেজন্য সরকারি ব্যয়ের প্রয়োজনে ঋণগ্রহণ যুক্তিসংগত নয়। পরবর্তীকালে কেইন্সীয় ভাবধারার বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদরা সরকারি ঋণের পক্ষে জোরালোভাবে মতামত তুলে ধরেন। তাঁদের মতে, অর্থনীতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্ণনিয়োগ অর্জিত হয় না, পূর্ণনিয়োগ অর্জনের জন্য সরকারের আয়-ব্যয় নীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই সরকারি ব্যয়ের আয়তন বৃদ্ধির স্বার্থে সরকারি ঋণ বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য সবসময় অমঙ্গল নয়। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ দেশের বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকারি ঋণ গ্রহণের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।
(i) আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করার জন্য আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, বিদ্যুৎ, পরিবহন ইত্যাদি বিষয়াবলিকে যুগোপযোগী করতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে শুধুমাত্র সরকারি সম্পদের মাধ্যমে এরূপ নির্মাণ কাজ সমাধা করা সম্ভব হয় না। তখন বাধ্য হয়েই সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
(ii) জরুরি অবস্থা মোকাবিলা
অর্থনীতিতে হঠাৎ জরুরি অবস্থার উদ্ভব হতে পারে। যেমন- জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ-এরূপ অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এরূপ অবস্থা মোকাবিলা করা রাষ্ট্রের চিরাচরিত উৎস দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ কর রাজস্ব বা কর বহির্ভূত রাজস্ব যখন তখন বাড়ানো যায় না। তখন ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ এবং সরকার জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে এ নীতি বাস্তবায়ন করতে পারে।
(iii) ঘাটতি বাজেটে অর্থায়ন
দরিদ্র, উন্নয়নশীল, জনবহুল দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে পড়ে। উন্নত দেশেও এরূপ অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। এরূপ ঘাটতি বাজেট মোকাবিলায় সরকার কর আরোপ, নতুন মুদ্রা হাপানো বা ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে নতুন কর নীতি বাস্তবায়নে বিরোধীদল বাধা সৃষ্টি করবে, নতুন মুদ্রা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতির ভয় থাকবে। এক্ষেত্রে সহজ পন্থা হলো সরকারি ঋণ গ্রহণ, যেখানে রাজনীতি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না বা মুদ্রাস্ফীতিও তেমন দেখা দেয় না।
এছাড়া আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যবধান বা Trade-Gap পূরণের জন্যও সরকার ঋণ গ্রহণ করে। রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি অধিক হলে এরূপ ঘাটতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
(iv) সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি
সরকার দেশের জনগণের মাঝে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র যেমন- প্রাইজবন্ড, প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, বোনাস সঞ্চয়পত্র, ওয়েজ আর্নার বন্ড ইত্যাদি বিক্রি করে ঋণ গ্রহণ করে। গৃহীত ঋণ পুনরায় দেশে বিনিয়োগ করলে নতুন কর্মসংস্থান, আয় সৃষ্টি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে দেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করে।
(v) উৎপাদন বৃদ্ধি
সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য ঋণ গ্রহণ করে। এরূপ ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য করনীতি ও মুদ্রা সৃষ্টির নীতি অপেক্ষা ঋণনীতি অনেক বেশি সহায়ক। এভাবে সংগৃহীত ঋণ উন্নয়ন পরিকল্পনায় ব্যয়ের মাধ্যমে দেশের নিয়োগ, আয় ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
(vi) কল্যাণ সর্বোচ্চকরণ
উন্নয়নশীল দেশের সরকার সবসময় জনগণের কল্যাণ সর্বোচ্চ করতে চায়। এজন্য বিভিন্ন সেবাসমূহ যেমন- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, গবেষণায় সহায়তা, দরিদ্র, দুস্থ, বৃদ্ধদের ভাতা প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, এতিমখানা, লঙ্গরখানা পরিচালনা, স্বল্পমূল্যে রেশন প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে জনকল্যাণ বৃদ্ধি করতে চায়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ব্যয় করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা সহজভাবে সংগ্রহ করা যায় না বলে সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
(vii) অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন
উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত অর্থনীতিতেও আয়, নিয়োগ, উৎপাদন এবং দাম স্তরের উত্থান-পতন খুবই বেশি লক্ষ করা যায়। এরূপ উত্থান-পতন ঠেকানোর জন্য অর্থনীতিবিদরা সরকারি ঋণকে শক্তিশালী হাতিয়ার মনে করে। মন্দাকালীন সময়ে দেশের অর্থনীতিতে তীব্র বেকার সমস্যা বিরাজ করে। এরূপ অবস্থায় করনীতি মন্দাবস্থাকে আরো তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী করবে। কিন্তু তখন সরকার ঋণ গ্রহণ করে সংগৃহীত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বেকার সমস্যাকে লাঘব করতে পারে। ঋণনীতি মন্দা এবং সমৃদ্ধি উভয় অবস্থাকে মোকাবিলা করতে সহায়ক। তাই সরকার ঋণ গ্রহণ করে।
এছাড়া সরকার রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যয়ের মধ্যকার সময়ের ব্যবধানের সময় রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য, সমাজে ধনী- দরিদ্রের মধ্যে আয়ের বৈষম্য দূরীকরণে এবং যুদ্ধকালীন ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করে।
বৈদেশিক সাহায্য কি, কত প্রকার ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক সাহায্যের ভূমিকা |