হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য
আধুনিক যুগে আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করার জন্য আগ্রহী বিভিন্ন পক্ষকে প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক আর্থিক তথ্য সরবরাহ করা হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য । আগ্রহী পক্ষসমূহকে প্রধানতঃ দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) আভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারী (Internal user) ও (২) বহিঃ ব্যবহারকারী (External user)।
ব্যবসায় পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ হল হিসাব তথ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারী। অপরদিকে বর্তমান ও ভবিষ্যত বিনিয়োগকারী, ঋণদাতা, পাওনাদার, কর্মচারী ও শ্রমিক সংঘ, ব্যাংক, সরকার, কর কর্তৃপক্ষ-এরা হল হিসাব তথ্যের বহিঃ ব্যবহারকারী। হিসাব তথ্যের এই সমস্ত আগ্রহী পক্ষসমূহকে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সহায়ক গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক তথ্য প্রদানের জন্য সর্ব প্রথম ব্যবসায়িক লেনদেনসমূহকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করতে হয়। পরবর্তীতে এগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে আগ্রহী পক্ষসমূহের সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী বিভিন্ন তথ্য প্রদান করা হয়। যেমন আর্থিক হিসাব বিজ্ঞান (Financial Accounting) এর কাজ হল প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ফলাফল ও অবস্থা সম্মন্ধে তথ্য প্রদান করা। আর ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞানের (Management Accounting) এর কাজ হল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা। অপরদিকে উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞানের (Cost Accounting) কাজ হল পণ্য উৎপাদন ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করে আর্থিক ও ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান উভয়কে সহায়তা করা।
হিসাববিজ্ঞানের নীতিমালা কাকে বলে ও বৈশিষ্ট্য সমূহ |
আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হল সঠিক ও যথার্থ হিসাব তথ্য (Accounting information) আগ্রহী পক্ষসমূহকে প্রদান করা যা নিম্নোক্ত দু’ভাগে আলোচনা করা যায়-
(খ) সহায়ক উদ্দেশ্যসমূহ।
(ক) মৌলিক উদ্দেশ্যসমূহ।
(ক) মৌলিক উদ্দেশ্যসমূহ
নিম্নে হিসাববিজ্ঞানের মৌলিক উদ্দেশ্য বর্ণিত হল-
(১) স্থায়ী হিসাব সংরক্ষণ
দৈনন্দিন অসংখ্য আর্থিক লেনদেন দীর্ঘদিন মনে রাখা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তারিখ ও প্রকৃতি অনুযায়ী স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়।
এজন্য আর্থিক লেনদেনসমূহ সঠিকভাবে সম্প্রক্ষণ করার উদ্দেশ্যে প্রথমতঃ ক্রয় বহি, বিক্রয় বহি, ক্রয়ফেরত বহি, নগদান বহি, সাধারণ জাবেদা বহি ইত্যাদি বিভিন্ন বহিতে প্রকৃতি অনুযায়ী ও সুবিধাজনকভাবে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে এসব উপাত্তগুলো প্রক্রিয়াজাত করা হয় আর্থিক ফলাফল ও অবস্থা নিরূপণের জন্যে।
(২) আর্থিক ফলাফল নির্ণয়
একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত আর্থিক লেনদেনসমূহকে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণীবদ্ধকরণ ও সংক্ষিপ্তকরণের পর উহার আর্থিক ফলাফল অর্থাৎ লাভ/লোকসান নির্ণয় করা হয়। লাভ/লোকসান নির্ণয় করার জন্য নিম্নোক্ত বিবরণী/হিসাবসমূহ তৈরী করতে হয়-
(i) উৎপাদন ব্যয় হিসাব: উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট হিসাব বছরে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় জানার জন্য এ হিসাব খুলে থাকে।
(ii) ক্রয় বিক্রয় হিসাব: ক্রয়কৃত পণ্য বা উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের ফলে মোট লাভ/ক্ষতি বের করার জন্য এ হিসাব খোলা হয়। এক্ষেত্রে বিক্রিত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বা ক্রয়ের সাথে অন্যান্য প্রত্যক্ষ খরচসমূহ যোগ করা হয়।
(iii) লাভ-লোকসান হিসাব: মোট লাভ হতে বাণিজ্যিক খরচ (Commercial expenses) যেমন প্রশাসনিক খরচ, পণ্য বিক্রয় ব্যয়, বন্টন বায় ইত্যাদি খরচ বিয়োগ ও অন্যান্য উৎস হতে আয় যেমন বিনিয়োগের সুদ ইত্যাদি যোগ করে নীট লাভ/ক্ষতি বের করার জন্য এ হিসাব খোলা হয়।
(৩) আর্থিক চিত্র প্রকাশ
হিসাবকালের শেষে একটি নির্দিষ্ট তারিখে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রকাশের উদ্দেশ্যে সমস্ত সম্পদ ও দায়সমূহের একটি বিবরণী তৈরী করা হয়, একে উদ্বর্তপত্র (Balance Sheet) বলে। ইহা কারবারের মূলধনের পরিমাণ মালিকী স্বত্ত্ব (Owners equity), দীর্ঘমেয়াদী ঋণের পরিমাণ মোট চলতি দায়, মোট স্থায়ী সম্পদ, বিনিয়োগ, চলতি সম্পদ ইত্যাদি প্রকাশ করে যা থেকে হিসাব তথ্যের ব্যবহারকারীগণ অন্তর্দায় ও বহির্দায় অনুপাত, বহির্দায়-স্বায়ী সম্পদ অনুপাত, চলতি মূলধন ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য বের করতে পারে যা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক। উপরোক্ত আর্থিক প্রতিবেদনসমূহ মূলতঃ হিসাব তথ্যের বই ব্যবহারকারীদের জন্যে তৈরী করা হয় ।
(৪) পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সহায়তা প্রদান
ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান হিসাব তথ্যসমূহকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ব্যবস্থাপকদের চাহিদা মোতাবেক এমনভাবে হিসাব তথ্য (Accounting information) উপস্থাপন করে যা তাদেরকে (অ) ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়ন (আ) নীতি নির্ধারণ (ই) মূল্য নির্ধারণ (ঈ) বাজেট প্রণয়ন (উ) ফলাফল মূল্যায়ন (ঊ) বিনিয়োগ সুযোগ বিশ্লেষণ গ্রহণ, প্রত্যাখ্যান, (ঋ) বিকল্প কর্মপন্থা (Alternative courses of Action) সমূহের আর্থিক গ্রহণযোগ্যতা নির্ণয়; (এ) ব্যবসায়িক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঝুঁকি নির্ণয় ও (ঐ) অন্যান্য আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
(খ) সহায়ক উদ্দেশ্যসমূহ
হিসাববিজ্ঞানের সহায়ক উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নে বর্ণিত হলঃ
(১) দৈনন্দিন দেনা-পাওনার পরিমাণ জানা ও নিষ্পত্তি
সুষ্ঠুভাবে হিসাব রাখা হলে প্রতিষ্ঠানের দেনা-পাওনার পরিমাণ সহজেই জানা যায় এবং যথাযথভাবে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়।
(২) জালিয়াতি উদঘাটন ও প্রতিরোধ
প্রতিষ্ঠানে হিসাববিজ্ঞান যতাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক জালিয়াতি সহজেই উদঘাটন ও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। কারণ সুষ্ঠু ও সঠিক হিসাব ব্যবস্থায় নিরীক্ষা কালে সহজেই জালিয়াতি ও অনিয়ম বের করা যায়।
৩) ব্যয় নিয়ন্ত্রণ
যথাযথ হিসাব ব্যবস্থায় একটি হিসাব বছরের বিভিন্ন সময়ে ব্যয়ের পরিমাণ জানা যায় এবং পূর্ববর্তী বছরের খরচের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণও করা যায়। ফলে গত বছরের তুলনায় এ বছরের খরচের হ্রাস বৃদ্ধির অনুপাতের সাথে আয়ের হ্রাসবৃদ্ধির অনুপাতের কারণ, ফলাফল ও দক্ষতা বিশ্লেষণ করা যায় যা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। তাছাড়া যথাযথভাবে হিসাব রাখলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ বিশ্লেষণ, স্থির ও পরিবর্তনশীল খরচ বিশ্লেষণ সঠিকভাবে করা যায় যা খরচের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
(৪) কর নির্ধারণে সহায়ক
সরকারের আয়ের অন্যতম মূল উৎস হল কর যা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে আইনের আওতায় আদায় করা হয়ে থাকে। তাই প্রতিটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট, বিক্রয় কর, আয়কর সঠিকভাবে নির্ধারণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আর্থিক লেনদেনকে লিপিবদ্ধ, শ্রেণীবদ্ধ ও আর্থিক ফলাফল নির্ণয় করতে হয়। যেমন যথাযথভাবে হিসাব রাখলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্রয়কৃত উপকরণ মূল্যের উপর প্রদত্ত ভ্যাট মোট বিক্রিত মূল্যের উপর প্রদেয় ভ্যাট হতে বাদ দেয়া যায়।
(৫) বিভিন্ন চলতি ও স্থায়ী সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ
সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে হিসাব সংরক্ষণের মাধ্যমে যে কোন সময় প্রতিষ্ঠানের চলতি ও স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ও বিবরণ জানা যায়। তদুপরি স্থায়ী সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যায় এবং উহাদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
৬) দায়িত্ববোধ, মূল্যবোধ ও জবাবদিহিতা সৃষ্টি
যথাযথ হিসাব ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, তছরূপ প্রতিরোধ করা যায় যা কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সুষ্ঠু হিসাব ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগ বা ব্যক্তির কার্যের ফলাফল মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় যা প্রতিষ্ঠানের সকল সতরে এবং মালিকের নিকট জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
(৭) বিরোধ এড়ানো
কারবারের যাবতীয় লেনদেনসমূহ সুষ্ঠু ও সুবিন্যস্তভাবে লিপিবদ্ধ করা হলে প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের যদি ভুলবুঝাবুঝি বা বিরোধ সৃষ্টি হয় তবে তা সহজেই নিষ্পত্তি করা যায়।
(৮) আইনগত চাহিদা পূরণ
আধুনিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। যেমন- কোম্পানী আইন, অংশীদারী আইন, কর অধ্যাদেশ, শুদ্ধ আইন, শিল্প আইন, সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ এ্যাক্ট ইত্যাদি। এ সমস্ত আইনের বিধি বিধান অনুযায়ী হিসাবরক্ষণ ও হিসাব তথ্য উপস্থাপন হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য ।
(১) হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই
দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে লেনদেনের হিসাব পক্ষসমূহকে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় বিধায় হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা যায়। ফলশ্রুতিতে সহজেই ভুলভ্রান্তি নির্ণয় ও সংশোধন করা যায়।
একতরফা দাখিলা পদ্ধতি কাকে বলে, বৈশিষ্ট্য ও অসুবিধা সমূহ |
(১০) আগ্রহী পক্ষসমূহের বিশ্বস্ততা অর্জন
প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ হল বিনিয়োগকারী, ব্যাংক, ঋণদাতা, পাওনাদারবৃন্দ, সরকার, শ্রমিক সংঘ এবং সর্বোপরি সচেতন জনগণ। যথাযথ হিসাব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত পক্ষসমূহের নিকট উহার আর্থিক প্রতিবেদন ও অন্যান্য হিসাব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এতে করে ঋণ প্রাপ্তি, তহবিল সংগ্রহ ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতা প্রাপ্তি সহজতর হয়।
(১১) সঠিক ও তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ
আধুনিক হিসাব ব্যবস্থা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক তথ্যসমূহ অত্যন্ত দ্রুত উপস্থাপন করতে পারে যা তাদেরকে সঠিক ও তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। সুতরাং দেখা যায় লেনদেনসমূহের স্থায়ী হিসাব সংরক্ষণ, আর্থিক প্রতিবেদন তৈরী এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য আগ্রহী পক্ষসমূহকে তাদের আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে এমন সঠিক হিসাব তথ্য প্রদান করাই হিসাববিজ্ঞানের মূখ্য উদ্দেশ্য।