আমদানি বিকল্প শিল্প
পৃথিবীর অপরাপর দেশ হতে আমদানিকৃত পণ্য-দ্রব্য হ্রাস করে উক্ত দ্রব্য উৎপাদনে দেশের অভ্যন্তরে শিল্প স্থাপন, উৎপাদন এবং যোগান দেয়াই হলো আমদানি বিকল্প শিল্প (Import Substitution Industry), আমদানি বিকল্প বলতে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি দ্বারা দেশীয় চাহিদা মেটানো বোঝায়। এরূপ শিল্পায়নের ফলে একটি দেশ তার বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি ব্যবধান হ্রাস করে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হতে পারে। কৃষি, শিল্প এবং সেবা প্রতিটি ক্ষেত্রে আমদানি বিকল্প ধারণা প্রয়োগ করা যায়। কোনো দেশের জনগণ যখন দেশপ্রেমিক ও সুনাগরিক হয়, তখন সেখানে এ নীতি প্রয়োগ করা সহজ হয়।
বাংলাদেশে আমদানি বিকল্প শিল্পের গুরুত্ব
বাংলাদেশের মতো জনবহুল, উন্নয়নশীল ও মূলধন স্বল্পতার দেশে প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খাদ্য সংকট লেগে থাকলে তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেন ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ঘাটতির বোঝা বাড়ে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সমস্যা ও সমাধান আলোচনা কর |
অবকাঠামো নির্মাণসহ শিল্পোন্নয়ন করার লক্ষ্যে প্রতি বছর বিদেশ হতে যন্ত্রাংশসহ কাঁচামাল আমদানিবাবদ প্রচুর অর্থব্যয় করতে হয়। দেশীয় শিল্পের কাঁচামালের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশের উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। ওষুধ, খাদ্যসামগ্রী, বিলাসজাতীয় দ্রব্য যেমন-স্বর্ণ অলংকার, গাড়ি, কসমেটিক্স প্রসাধনী প্রভৃতি আমদানি করার জন্যও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশি পণ্য বিদেশে তেমন রপ্তানি হয় না। ধনী দেশগুলো আমাদের মতো দেশগুলোকে নানারূপ কঠিন বাণিজ্য শর্তে আবদ্ধ করে রাখে। তাছাড়া অনেকক্ষেত্রে আমাদের দেশীয় পণ্যের গুণগত মান নিম্ন, দাম বেশি। তাই বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ি।
বৈদেশিক নির্ভরশীলতা হ্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নে আমদানি বিকল্প শিল্পের প্রয়োজনীয়তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
(ক) কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
বাংলাদেশে কর্মহীন, বেকার জনসংখ্যা প্রচুর। এ তীব্র বেকারত্বের বোঝা লাঘব করার লক্ষ্যে দেশীয় শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে আমদানি হ্রাস পাবে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বৃদ্ধি পাবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
(খ) দেশীয় শিল্পের সংরক্ষণ
বিদেশি শিল্পের প্রতিযোগিতার হাত থেকে দেশীয় নবীন শিল্পসমূহকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিদেশি শিল্প পণ্য আমদানি বন্ধ বা নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। এজন্য আমদানিকৃত পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক বসানো যায়। এর ফলে দেশীয় শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণতায় ফিরে আসবে। দেশীয় শিল্পের উৎপাদিত পণ্য দেশীয় নাগরিকদের ব্যবহারের উপযোগী হবে। এভাবে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে একসময় দেশীয় শিল্পসমূহ বিদেশি শিল্পের সাথে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ববাজারে টিকে থেকে মুনাফা আহরণ করতে পারবে।
(গ) অভ্যন্তরীণ বাজার প্রসারণ
আমদানি বিকল্প শিল্প দেশে স্থাপিত হলে উক্ত শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের দাম তুলনামূলক কম হবে। পণ্যটির বাজার সমগ্রদেশে বিস্তার লাভ করবে। এভাবে পণ্যের বাজার সম্পর্কিত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা দূর হওয়ার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়।
(ঘ) বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস
বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ আয় রপ্তানির মাধ্যমে আসে তার চেয়ে বেশি আমদানির মাধ্যমে ব্যয় হয়। ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশকে বাণিজ্য ঘাটতির সম্মুখীন হতে হয়। এ অবস্থা হতে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে একমাত্র পথ হলো আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপন করা।
(ঙ) বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়
আমদানি বিকল্প শিল্প গড়ে উঠলে দেশের আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাবে।
(চ) শিল্পায়ন
আমদানি বিকল্প শিল্পায়ন হলে দেশে প্রচুর শিল্পজাত দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা সম্ভব। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
(ছ) আত্মনির্ভরশীলতা সৃষ্টি
দেশে আমদানি বিকল্প শিল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠলে, দেশের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে মূলধন বাজার শক্তিশালী হবে, মূলধন দ্রব্য উৎপাদনের মাধ্যমে পরনির্ভরশীলতা দূরীভূত হবে। উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়ার মাধ্যমে এভাবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্ব-নির্ভর হবে।
(জ) দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন
আমদানি বিকল্প শিল্পব্যবস্থা গড়ে উঠলে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, কৃষি ও শিল্প উভয় খাতেই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, দেশে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।
এছাড়া, দেশীয় পণ্য ব্যবহার উপযোগী শিল্প স্থাপন করে আমদানি হ্রাস করা যায়। প্রয়োজনে বিদেশি বিলাসজাতীয় পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ বা হ্রাস করে এ খাতেও দেশীয় উদ্যোক্তাদেরকে সহযোগিতা প্রদান করা যায়।