খাদ্য নিরাপত্তা
খাদ্য নিরাপত্তার ধারণা বেশ পুরানো। প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে মিসরীয় ও চায়না সভ্যতায়ও এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। তখনও দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় খাদ্য মজুদ করে রাখা হতো। গত শতাব্দীর ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা ধারণা আনুষ্ঠানিক (formal) রূপ লাভ করে। তখন হতে খাদ্য নিরাপত্তা ধারণাটি জাতীয় পর্যায়ে চিন্তার বিষয় হিসেবে বিবেচনা শুরু হয়।
১৯৭৪ সালে বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনের মতে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, পর্যাপ্ত খাদ্যের যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং খাদ্য উৎপাদন ও এর দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা।
১৯৮৩ সালে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) খাদ্য নিরাপত্তার ধারণাটিকে আরও প্রসারিত করে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা সকল মানুষের সমগ্র জীবনের জন্য মৌলিক খাদ্য প্রাপ্তির ভৌত এবং অর্থনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তাকে নির্দেশ করে।
কাম্য জনসংখ্যা কি? কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্ব সমালোচনাসহ আলোচনা কর |
পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্য ও ক্ষুধা সংক্রান্ত এক রিপোর্টে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা বলতে সকল মানুষ সমগ্র জীবনব্যাপী কার্যকর ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তাকে বোঝায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (USDA) এর মতে, খাদ্য নিরাপত্তার অর্থ হলো একটি পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সর্বদা পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা যাতে তারা একটি কর্মঠ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারে।
বিবর্তনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা পাওয়া যায় ১৯৯৬ সালের বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে। এ সম্মেলনে বলা হয়, খাদ্য নিরাপত্তা হলো এরূপ একটি বিষয় যেখানে জনগণ সবসময় ভৌত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যে প্রবেশাধিকার লাভ করে যা তাদের সুস্বাস্থ্য ও কর্মময় জীবনের জন্য স্বাস্থ্যবিধি সম্মত প্রয়োজন মেটায়।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এই সংজ্ঞাটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক (Dimensions) হলো-
(i) খাদ্যের প্রাপ্যতা (Food availability),
(ii) খাদ্যের ক্রয়যোগ্যতা (Good access),
(iii) উপযোগিতা (Utilization) এবং
(iv) স্থিতিশীলতা (Stability).
অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝি, নির্ভরশীল স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের পর্যাপ্ত যোগান যা ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
খাদ্য নিরাপত্তার দিক সমূহ
খাদ্য নিরাপত্তা দারিদ্র্য দূরীকরণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শুধু খাদ্য নয়, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য। বিভিন্ন পর্যায়ে নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং উন্নয়নের ফলে গত দশকে তত্ত্বীয় ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন আসে।
ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহ অপেক্ষা এশিয়া ও আফ্রিকার শিশুসহ সকল মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার দিকসমূহ ঝুঁকিবহুল। ১৯৪০-৫০, এ সময়ে সকল অঞ্চলের মানুষের খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল। তখন এ ধারণা ছিল, Secure, adequate and suitable supply of food for everyone. তা গ্রহণযোগ্য ছিল আন্তর্জাতিকভাবে, দ্বি-পক্ষীয় ও বহু পক্ষীয় সংস্থাসমূহ তথা দাতা দেশ ও সংস্থাসমূহ কর্তৃক ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP)’র পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯৬০ সালের দিকে সম্পদশালী দেশসমূহ উন্নয়নের জন্য খাদ্য সাহায্যকে শর্ত হিসাবে ব্যবহার করেছে যা WFP ১৯৬৩ সালে চালু করে। নাটকীয়ভাবে, ১৯৭২-৭৪ সময়ে দাতা দেশসমূহের খাদ্যের যোগান এবং দামের মধ্যে অভারসাম্য বা অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়। ১৯৬০ সালে সবুজ বিপ্লবের ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তখন খাদ্য নিরাপত্তা ধারণা কাঠামোগত রূপ পায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রসারিত হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও দারিদ্র্য দূরীকরণে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচিত হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ১৯৯০ এর দিকে ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
খাদ্য নিরাপত্তার দিকসমূহকে চারভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন:
(i) নিশ্চিত বা পরমদিকসমূহ (Categorical dimension)
ii) সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক দিকসমূহ (Socio-Organizational dimension)
(iii) ব্যবস্থাপকীয় দিকসমূহ (Managerial dimension)
(iv) অবস্থা সম্পর্কিত দিকসমূহ (Situation-related dimension)
(i) নিশ্চিত বা পরমদিকসমূহ
দুটি নির্ণায়ক এ কাঠামোকে প্রভাবিত করে। একটি হলো ভৌত বা বাস্তব (physical), অপরটি হলো সময়গত (temporal) নির্ণায়ক। ভৌত নির্ণায়কটি খাদ্য প্রবাহ (Food flow) ধারণার সাথে যুক্ত এবং এটি তিনটি উপাদানকে আলোচনা করে। তা হলো:
ক. খাদ্যের প্রাপ্যতা বা পর্যাপ্ততা (Food availability)
খ. খাদ্যের ক্রয়যোগ্যতা (Food accessibility) এবং
গ. খাদ্যের উপযোগিতা বা ব্যবহার (Food Use)
(ii) সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দিকসমূহ
সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দিকসমূহ তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
Micro Level এ ব্যক্তি ও পরিবার।
Meso Level এ উপজেলা, জেলা, রাজ্য ইত্যাদি বোঝায়।
Macro Level এ একটি জাতি, দেশ বা বিশ্বকে বোঝায়।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সমালোচনা সহকারে আলোচনা কর |
কিন্তু তিনটি ভাগই পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। তিনটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমান সামাজিক সংগঠনসমূহের আর্থিক সামর্থ্যের ভিন্নতার কারণে খাদ্য ও অপুষ্টির (malnutrition) মাত্রাগত পরিবর্তন ঘটে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা একই সাথে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক্ষেত্রে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠনসমূহের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
(iii) ব্যবস্থাপকীয় দিকসমূহ
এটি খাদ্য নিরাপত্তার তৃতীয় দিক (third dimension)। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে এই পর্যায় সম্পাদন করে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ কর্তৃক অনুসৃত মডেলটি হলো UNICEF: Triple A-Assessment-Analysis-Action |
এক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সমস্যা সমাধানে পথ নির্ধারণ ও কর্ম সম্পাদন-এভাবে অগ্রসর হয়ে কাম্য সমাধান নির্ণয়ের কথা বলা হয়েছে।
(iv) অবস্থা-সম্পর্কিত দিকসমূহ
খাদ্য নিরাপত্তার চতুর্থ দিক (forth dimension)। জরুরি প্রয়োজনের সময় যখন দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলে, তখন খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা যায় না। আবার যারা দরিদ্র, হতদরিদ্র ভাসমান মানুষ, বস্তিবাসী; সেখানে খাদ্য ও পুষ্টি সমস্যা লেগেই থাকে। কাজের বিনিময়ে খাদ্যসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নিয়োজিত, নিম্ন মজুরিতে কর্মরত শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এরূপ সমস্যা লক্ষ্য করা যায়।