আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় যতই শীর্ষে অবস্থান করুক কোনো ব্যক্তি বা দেশ একা তার প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য সংস্থান করতে পারে না। অন্য ব্যক্তি বা দেশের উৎপাদিত পণ্য-সেবা তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। এ ধারণা হতেই আন্তর্জাতিক বিনিময় ব্যবস্থা তথা বাণিজ্যের সূত্রপাত হয়। দেশের সীমানা পেরিয়ে দু বা ততোধিক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের মধ্যে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রব্য ও সেবার বিনিময় সম্পন্ন হলে তাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলে। বিশ্বের কোনো একটি দেশের সাথে অন্য কোনো দেশের বা একাধিক দেশের বৈধ প্রক্রিয়ায় যে বাণিজ্য চলে, তাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলে। অন্যভাবে বলা যায়, International trade is the exchange of goods or resources among the countries, অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্রব্য ও সম্পদের বিনিময়কে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলে। প্রাচীনকাল হতেই ইউরোপের বণিকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কলোনি স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পর চলমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রকৃতি পরিবর্তন হয়, গতি ও আওতা বৃদ্ধি পায়। মূলত তখন হতেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন প্রয়োজনীয় পণ্য ও উৎপাদন কৌশল আদান-প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভিত্তি
পৃথিবীতে প্রত্যেক দেশেরই বিদ্যমান সম্পদ এবং উৎপাদন ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদের পার্থক্য, স্ব-স্ব দেশে উপকরণের প্রাচুর্যতার উপর নির্ভর করে উৎপাদন বা দুটি ভিন্ন দেশে দুটি ভিন্ন দ্রব্য উৎপাদনে আপেক্ষিক ব্যয় সুবিধা ভোগ করার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংঘটিত হয়। দুটি দেশের মধ্যে উপকরণের সহজলভ্যতা, দক্ষতা ও উৎপাদনের মধ্যে বিশেষীকরণ এবং শ্রমবিভাগই হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল ভিত্তি। যে দেশ যে দ্রব্যটি বেশি উৎপাদন করে তার উদ্বৃত্ত অংশ রপ্তানি করে বিনিময়ে প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য অন্য কোনো দেশ হতে আমদানি করে। এভাবে পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে দু বা ততোধিক দেশ বাণিজ্যে নিয়োজিত হলে তাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত শর্ত আবশ্যক:
১. একটি নির্দিষ্ট সময় বিবেচ্য,
২. কমপক্ষে দুটি দেশ ও এক বা একাধিক পণ্য প্রয়োজন,
৩. দেশসমূহ স্বাধীন-সার্বভৌম হওয়া প্রয়োজন, দুটি পৃথক সরকার, ব্যাংক ও মুদ্রা ব্যবস্থা বিদ্যমান,
৪. ৫. দুটি দেশে পৃথক বাণিজ্যনীতি বিদ্যমান ও
৬. পণ্য-সেবা বিনিময়ে লিখিত চুক্তি আবশ্যক।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব আলোচনা কর |
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একটি দেশের সম্পদ বৃদ্ধিতে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বিষয়টি যেকোনো একটি দেশের প্রেক্ষিতে আলোচনা করলে সহজে অনুধাবন করা যায়। যেমন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ বাণিজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো:
১. সম্পদের উত্তম ব্যবহার: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিবিদ্যা আমদানির ফলে নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর উত্তম ব্যবহারের দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের বাজার বিস্তৃত হলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
২. উৎপাদন বৃদ্ধি: পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ নিজেদের সম্পদ ও উপকরণ প্রাপ্তির সুবিধা, দক্ষতা অনুসারে সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত দেশগুলোর মোট উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীর মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উক্ত দেশসমূহের শিল্প প্রতিষ্ঠানের আয়তন বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানসমূহ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ব্যয় সংকোচন’ সুবিধা ভোগ করে।
৩. উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানি: কোনো দেশ তার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি দ্রব্য উৎপন্ন করে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে আয় বৃদ্ধি করতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে তার উদ্বৃত্ত পণ্য কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
৪. অনুৎপাদিত দ্রব্য ভোগের সুবিধা: কোনো দেশ কোনো বিশেষ দ্রব্য উৎপাদন করতে না পারলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে তা আমদানি করে ভোগ করতে পারে। যেমন-বাংলাদেশ কম্পিউটার, সেলাই মেশিন, রেফ্রিজারেটর প্রভৃতি আমদানি করতে পারে। আবার পাট, চা, চামড়া অন্যান্য দেশে রপ্তানি করতে পারে।
৫. মূলধনী দ্রব্য আমদানি: বাংলাদেশের ন্যায় দরিদ্র দেশের উন্নয়নের জন্য মূলধনী দ্রব্যের প্রয়োজন কিন্তু নিজেদের প্রযুক্তিতে জ্ঞান ও সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এরূপ দ্রব্য উৎপাদনের কাঠামো স্থাপন করতে পারে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের মাধ্যমে কম খরচে মূলধনী দ্রব্য আমদানি করতে পারে।
৬. অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্য আমদানি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে বাংলাদেশ অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য যেমন- খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য আমদানি করতে পারে।
৭. খাদ্য ঘাটতি পূরণ: বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই খাদ্য ঘাটতি থাকে। এ ঘাটতি পূরণ করার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সুবিধা থাকা প্রয়োজন। কারণ ঘাটতিকালীন সময়ে একাধিক দেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে তা পূরণ করা হয়।
৮. কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান: বাংলাদেশের মতো অনুন্নত এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এমতাবস্থায় এসব দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমেই শিল্পোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান ও পরিচালনা দক্ষতা লাভ করতে পারে।
৯. ভোক্তাদের সুবিধা: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত দেশের ভোক্তাগণ কম মূল্যে উন্নতমানের পণ্যদ্রব্য ও সেবা ভোগ করতে পারে।
১০. দেশীয় বাজার সম্প্রসারণ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কারণে বিশ্বব্যাপী দেশীয় বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে উৎপাদনকারীদের উৎপাদন ক্ষমতা এবং মুনাফা উভয়ই বৃদ্ধি পায়।
১১. মূলধনের গতিশীলতা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের সাথে একাধিক দেশের বাণিজ্যিক সুবিধার কারণে মূলধনের আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে এর গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
১২. মানব সম্পদ রপ্তানি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত দেশসমূহ শ্রমশক্তি বা মানবসম্পদ রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। এর মাধ্যমে দেশীয় শ্রমবাজারের বেকারত্ব হ্রাস পায়, দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়।
১৩. নির্ভরশীলতা হ্রাস: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো লাভবান হলে ধীরে ধীরে অর্থনীতি স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়।
১৪. জরুরি অবস্থা মোকাবিলা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছাস প্রভৃতি কারণে জরুরি অবস্থা দেখা দিলে অন্য দেশ হতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি করে অথবা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে অতি সহজেই এরূপ সংকট মোকাবিলা করা যায়। সাম্প্রতিককালে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ কয়েকটি দেশে ‘সুনামি’ পরবর্তী যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয় সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরোক্ষ প্রভাব বলা যায়।
১৫. দক্ষতা বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত দেশগুলোর উৎপাদনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কারণ এ ধরনের উৎপাদকগণ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কম খরচে উন্নতমানের দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োজিত হয়।
১৬. জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসার: বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে বিভিন্ন দেশ পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে এবং এর ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটে।
১৭. একচেটিয়া কারবার প্রতিরোধ: বৈদেশিক বাণিজ্যের দ্বারা দেশের মধ্যে একচেটিয়া কারবারের সম্প্রসারণ রোধ করা সম্ভব।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ কি কি – আলোচনা কর |
১৮. রপ্তানিনির্ভর উন্নয়ন: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কোনো দেশ রপ্তানিনির্ভর হলে বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বৃদ্ধি পায়, টেকসই (Sustainable) অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
১৯. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদান ঘটে। ফলে বাণিজ্যে লিপ্ত দেশগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এভাবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সম্প্রীতি অর্জিত হয়। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস ‘সিডর’ আঘাত হানার পর প্রাণহানিসহ যে বিপর্যয় দেখা দেয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদার সহযোগিতার ফলে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একান্তভাবেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। এর মাধ্যমে জনশক্তির মান উন্নয়ন, শিল্পের বিকাশ সাধন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন সবই সম্ভব। তাই বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশল বৈদেশিক ঋণনির্ভর না হয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যনির্ভর হওয়া উচিত।