হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতই অতি প্রাচীন। মানব সভ্যতার শুরুর সঙ্গে সঙ্গোই হিসাববিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। আদিমকালের হিসাব ব্যবস্থা ছিল অপদ্ধতিগত, অবৈজ্ঞানিক, অনুন্নত ও অপরিপক্ক। হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি এর আদি ইতিহাস সঠিকভাবে নির্ণয় করতে না পারলেও বলা যায় প্রায় চার হাজার বৎসর পূর্ব হতেই হিসাববিজ্ঞানের প্রচলন ছিল। প্রাচীন ব্যবলিয়ন, রোম, মিসর, মহেনজোদারো প্রভৃতি সভ্যতায় হিসাব ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।
হিসাববিজ্ঞানের নীতিমালা কাকে বলে ও বৈশিষ্ট্য সমূহ |
সত্যতার ক্রমবিকাশ ও আর্থিক কার্যাবলীর প্রয়োজন, পদ্ধতি, সিদ্ধান্ত, কলা-কৌশল ইত্যাদির প্রয়োজনে হিসাববিজ্ঞানের পরিধি ও কার্যাবলীতে বিস্তৃতি ঘটেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিসাববিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা চলতেই থাকবে। হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাসকে নিম্নলিখিত চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ
(১) উন্নয়ন পর্ব (Development Period)
(২) প্রাক বিশ্লেষণ পর্ব (Pre-Explanatory period)
(৩) বিশ্লেষণ পর্ব (Explanatory period)
(৪) আধুনিক পর্ব (Modern Period)
উপরোক্ত শ্রেণী পর্বসমূহকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলঃ
(১) উন্নয়ন পর্ব (Development Period up to 1494)
মানব সভ্যতার শুরু হতে ১৪৯৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে এই পর্বের অন্তর্ভুক্ত করী হয়েছে। এই পর্বে মানব সভ্যতার বিভিন্ন বিবর্তন ক্রমকে দেখান হয়েছে। উন্নয়ন পর্বকে আবার নিম্নলিখিত চার ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
(ক) প্রস্তর যুগ
(খ) প্রাচীন যুগ
(গ) বিনিময় যুগ
(ঘ) মুদ্রা যুগ।
(ক) প্রস্তর যুগ
প্রস্তর যুগে মানুষ বনে জঙ্গলে বা গুহায় বাস করত। গাছের ফল মুল সংগ্রহ করে এবং বন্য পশু শিকার করে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। সেইযুগে মানুষ গুহার অভ্যন্তরে তাদের শিকারকৃত জীবজন্তুর সংখ্যা এবং সংগৃহীত ফল মূলের সংখ্যা পাথরের সাহায্যে প্রাচীরের গায়ে খোদাই করে রাখত এবং গণনার কাজে প্রস্তর খন্ড ব্যবহার করত। এভাবে গণনার সাহায্যে প্রাচীরের গায়ে হিসাবরক্ষণ দ্বারা হিসাবশাস্ত্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল।
(খ) প্রাচীন যুগ
আস্তে আস্তে মানুষ পাহাড়ের গুহা ছেড়ে সমভূমিতে বসবাস শুরু করে। কৃষি কাজের কৌশলাদি আয়ত্ত করে। এ সময়ে ঘরের দেয়ালে দাগ কেটে এবং রশিতে গিরা দিয়ে উৎপাদিত ফসল ও তার মজুদের হিসাব রাখার রীতি চালু করে।
(গ) বিনিময় যুগ
সমাজের আয়তন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে লাগল। প্রাথমিক অবস্থায় মানুষ নিজের চেষ্টায় নিজের প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম ছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা পূরনের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হল। পণ্য বিনিময় প্রথা শুরু হল। মানুষ নিজ উৎপাদন ছাড়াও পণ্য বিনিময়ের হিসাব রাখতে শুরু করল। এ সময়ে দরজার কপাটে অথবা মাটির দেয়ালে রং দিয়ে দাগ কেটে হিসাব রাখত।
(ঘ) মুদ্রা যুগ
বিনিময় যুগে পণ্য বিনিময়ের অসুবিধা দূর করবার জন্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে মুদ্রার প্রচলন হয়। পেশাগত বণিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে এবং মানুষ লেখা-পড়া শিখে। ক্রমে ক্রমে মানুষ বাকীতে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় শুরু করে। যাবতীয় পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও পণ্য সামগ্রীর হিসাব লিখে রাখতে শুরু করে। হিসাব রাখার কোন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি জানা ছিল না বলে, বিভিন্ন হিসাব মোট আকারে লিখে করত যাকে আমরা বর্তমানে একতরফা পদ্ধতি হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকি।
(২) প্রাক বিশ্লেষণ পর্ব (Pre-Explanatory Period 1494-1800)
ব্যবসা বাণিজ্যের জটিলতা ও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে হিসাববিজ্ঞানের জটিলতা ও উন্নতি দেখা দেয়। ১৪৯৪ সালে লুকা গ্যাসিওলি নামক এক পাদ্রি Summa De Arithmetica Geomatrica Proportion et Proportionalita নামক বইটিতে দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিতে হিসাবরক্ষণের প্রণালী উল্লেখ করেন। এই পদ্ধতিতে ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয় সূত্র, জাবেদা, খতিয়ান রেওয়ামিল ইত্যাদি বিষয়ে পরিষ্কারভাবে আলোচনা করা হয়। এই দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিকে ভিত্তি করেই বর্তমান হিসাববিজ্ঞান তার নিজস্ব নিয়মে ক্রমে বিবর্তিত হচ্ছে।
হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সমূহ আলোচনা কর |
(৩) বিশ্লেষণ পর্ব (Explanatory Period 1800-1900)
যৌথ মূলধনী কারবারের আর্বিভাব বৃহদায়তন উৎপাদন, বিভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়া, বহুমূখী উৎপাদন, কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক মালিক সম্পর্কের জটিলতা, প্রতিযোগিতা, সরকারী নিয়ন্ত্রণ, অধিক মুনাফা অর্জনের আকাংখা ইত্যাদি কারণে হিসাব ব্যবস্থায় নতুন নতুন সমস্যা দেখা দেয় এবং নানা জটিলতার উদ্ভব ঘটে। এইসব জটিলতা ও সমস্যার সমাধান খুজে বের করার জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় হিসাববিজ্ঞান শাস্ত্রের বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া। এই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিসাবরক্ষকদের মান উন্নয়নের জন্য হিসাব পেশাদারী সংস্থার উদ্ভব হয় যেমন ১৮০০ সালে যুক্তরাজ্যে, ১৮৮৭ সালে আমেরিকায়। উক্ত সময়ে হিসাববিজ্ঞান শাস্ত্র নানারূপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্রসর হতে থাকে।
(৪) আধুনিক পর্ব (Modern Period 1900 on words)
বিংশ শতাব্দীতে মানব সভ্যতার ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে দ্রুত ও অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। ফলে হিসাববিজ্ঞানের আওতা ও কার্যকলাপ সম্প্রসারিত হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিসাববিজ্ঞান তার নিজস্ব শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয় যেমন- আর্থিক হিসাববিজ্ঞান, উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান, আয়কর নির্ধারণ হিসাব, নিরীগ হিসাব বিদ্যা, সামাজিক হিসাব ও বাজেট সংক্রান্ত হিসাবের সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিককালে কম্পিউটার যন্ত্র আবিস্কারের ফলে হিসাববিজ্ঞানের কলা কৌশল ও রক্ষণ পদ্ধতি অনেক সহজ হয়েছে।
উপসংহারে বলা যায় যে, হিসাববিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই থাকবে। হিসাববিজ্ঞান পদ্ধতির আরও উন্নতি ও যুগ উপযোগী করার লক্ষ্যে বিশ্বের পন্ডিত ব্যক্তিগণ, বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। ১৯৭৩ সালে হিসাব ব্যবস্থার নীতি ও প্রয়োগ পদ্ধতিগুলির সার্বজনীনতা আনবার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যে International Accounting Standard Committee নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশও এর সদস্য। এই সংস্থা বিভিন্ন বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করে এর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে।