জ্ঞাতি সম্পর্কের গুরুত্ব
জ্ঞাতি সম্পর্ক সমাজ সংগঠনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বস্তুত জ্ঞাতি সম্পর্কের বন্ধনই সমাজের বিভিন্ন মানুষকে সংগঠিত করে, সৃষ্টি করে মানব সম্পর্কের এক জটিল অধ্যায়। পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি সমাজের বিচিত্র পরিমণ্ডলে জ্ঞাতি সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আদিম কি আধুনিক প্রায় সব সমাজেই জ্ঞাতি সম্পর্ক হচ্ছে সমাজ কাঠামোর চাবিকাঠি।
কোন সমাজ অবশ্য আপেক্ষিক অর্থে জ্ঞাতিত্ব বোধহীন হতে পারে। কিন্তু জ্ঞাতি মানসিকতা দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। দীর্ঘদিন ভুলে যাওয়া এমন কোন নিকট আত্মীয় ব্যক্তিকে যদি কেউ হঠাৎ তার সংকট অবস্থায় সাক্ষাৎ পায় তবে কি কেউ জ্ঞাতি বলে তার জন্য কিছুই করবে না? অতি আপনজনের কি কোন কিছুই আবদার করার নেই? আছে বৈকি। এ জন্যই বলা হয়েছে, Blood is thicker than water, অর্থাৎ, পানির চেয়ে রক্তের ঘনত্ব বেশি।
জ্ঞাতি সম্পর্ক বিষয়ে অর্জিত জ্ঞান কোন সমাজের কাঠামো অনুধাবনে সাহায্য করে। সমাজ কাঠামো বলতে অনেক সময় সমাজস্থ ব্যক্তির আন্তঃব্যক্তি সম্পর্ককে বুঝায়। ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কই সমাজ কাঠামোর মৌল বিষয় এবং এ পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হলো জ্ঞাতি সম্পর্ক। কেননা আমরা সবাই রক্ত সম্পর্কের সূত্রে নতুবা বৈবাহিক সূত্রে, নতুবা দত্তক হিসেবে বা কাল্পনিক জ্ঞাতি হিসেবে একে অপরের নৈকট্য অনুভব করি। বিশেষকরে কোন সমাজের পরিবার নামক ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠনকে জ্ঞাতি সম্পর্ক বিশ্লেষণ ছাড়া সম্ভব নয়। তাছাড়া আদিম সমাজের কাঠামো বিশ্লেষণে জ্ঞাতি সম্পর্ক একটি পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে। মর্গানের কাছে জ্ঞাতি সম্পর্ক বিশ্লেষণ ছিল আমেরিকান ইন্ডিয়ান সমাজের কাঠামো বিশ্লেষণ পদ্ধতি। তিনি জ্ঞাতি সম্পর্কের পদ বিশ্লেষণে সেখানকার পরিবার কাঠামো এবং সম্পত্তির মালিকানার স্বরূপ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের হিন্দু বা মুসলিম সমাজে যদি একজন যুবক কাউকে বাবা বলে সম্বোধন করে তবে আমরা বুঝে নিতে পারে যে যুবকটি ঐ ভদ্রলোকের সন্তান এবং সে ভদ্রলোকটির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।
আদিম সমাজে এমনকি আধুনিক কালেও জ্ঞাতি সম্পর্ক আর্থ রাজনৈতিক কাজকর্মে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আদিম সমাজে মানুষ তখন বহির্গোত্র বিবাহ প্রথার প্রচলন করে তখন তারা পাত্রপাত্রী নির্বাচনের সময় লক্ষ রাখতো কোন অঞ্চলে শিকার, ভূমি, জলাশয় বনবাগান বেশি রয়েছে। কেননা ঐ অঞ্চলে জ্ঞাতি সৃষ্টি করতে পারলে স্থানান্তর সহজ হয়। নেতৃত্বের আতি সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা সে আদিমকালের সমাজেই হোক বা আধুনিক সমাজেই হোক। নির্বাচনের সময় জ্ঞাতি সম্পর্কের বন্ধন ভোট পেতে সহায়ক বলে বিবেচিত।
আরও পড়ুন: জ্ঞাতি সম্পর্ক কি? জ্ঞাতি সম্পর্ক কত প্রকার ও কি কি?
আধুনিক কালের জাতীয়তাবোধ বস্তুত তথাকথিত আদিম সমাজের আতি সম্পর্ক বোধের সম্প্রসারিত রূপ। জ্ঞাতি বন্ধনে দৃঢ় আদিম জনগোষ্ঠী যেমন গোষ্ঠী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও নিজস্ব জ্ঞাতি গোষ্ঠীর মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষায় যেমন ছিল তৎপর ঠিক তেমনি আজকের যুগে জাতীয়তাবোদে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠী বা জ্ঞাতি নিজেদের স্বার্থ ও অধিকার অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই জাতীয়তাবোধের ফলশ্রুতিই হলো আধুনিক কালে স্বাধীনতা প্রাপ্ত জাতীয় রাষ্ট্রসমূহ গতিশীল শিল্পায়িত সমাজে মানুষ আত্মীয়–স্বজনের উপর নির্ভরের চেয়ে তার স্বীয় প্রচেষ্টা সভা, সমিতি, হাসপাতাল, সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা, আইন বিচার ও অন্যান্য সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সহকর্মীদের সঙ্গেও এক ধরনের বন্ধুত্বমূলক জ্ঞাতি সম্পর্ক গড়ে উঠে। আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে একান্ত নিজস্ব পরিবারও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে জ্ঞাতি সম্পর্কের বন্ধন কম দৃঢ় নয়। প্রাচীন ও অন্যান্য ক্ষুদ্রাকৃতির সমাজে জ্ঞাতি ও গোষ্ঠী চেতনা তথা পরিবারের গুরুত্ব সমধিক।
উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা একথা বলতে পারি যে, সমাজজীবনে বিবিধ কাজের মাধ্যমে জাতি সম্পর্ক প্রেরণা, প্রীতি ইত্যাদির জন্ম দেয়। আবার কখনো কখনো স্বার্থের জন্য এক জাতি অন্য জাতির জন্য শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের সমাজজীবনে তার আচার–আচরণ নিয়ন্ত্রণে তথা সামাজিক দল গঠনে জ্ঞাতি সম্পর্কের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।