সম্পত্তির বিবর্তন
সম্পত্তির ধারণা মানুষের মনে কিভাবে উদ্ভব হয়েছে? কিভাবে সমাজে সম্পত্তির স্বত্ত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? এসব প্রশ্নের অনুসন্ধানে সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীগণ ব্যাপক গবেষণা করেছেন। নিম্নে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও সামাজিক নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণার আলোকে মানবসমাজের বিভিন্ন স্তরে সম্পত্তির বিবর্তনের ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
বর্তমানকালে আমাদের মনে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সম্পর্কিত যে ধারণা তা সুদূর অতীতে ছিল না। বিভিন্ন সময়ে সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে আমরা সম্পত্তির ধারণা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার বিভিন্ন তাৎপর্য দেখতে পাই।
সমাজে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে কাজ করতে হয়। কাজের বিনিময়ে যা অর্জন করে তা দিয়ে ভরণপোষণ ও নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য ব্যয় করা হয়। তাছাড়া আগামী দিনের জন্য তার সঞ্চয়েরও প্রয়োজন অনুভব করে। মানুষের মনে এসব ধারণা সমাজ বিকাশের সাথে সাথে নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। অথচ সমাজের বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে আমরা ব্যক্তিগত মালিকানা ও সম্পত্তির ধারণা আলোচনা করলে দেখতে পাব যে, মানুষের উৎপাদন পদ্ধতি ও জীবিকা পদ্ধতির উপর নির্ভর করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ও কোন জিনিসের উপর মালিকানার চেতনা দানা বেঁধে উঠেছে। সমাজ যতই সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে ততই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের চেতনা ও ব্যক্তিগতভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেরণা বেড়েছে। সামাজিক সূত্রে যখন মানুষের পরিচিতির মূল্য বেড়েছে তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের চেতনা ও ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তি ভোগের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
আরও পড়ুন: শিল্প সমাজ কি? শিল্প সমাজের বৈশিষ্ট্য এবং সম্পত্তির সংজ্ঞা
১. আদিম সমাজে সম্পত্তি
বর্তমানে আমরা দেখতে পাই যে, সমাজের লোকেরা সমাজে স্বীকৃত উপায়ে যা সংগ্রহ করে তার উপর কর্তৃক সমাজ স্বত্বস্বীকৃত হলে সেটার সম্পত্তি বলে গণ্য হয়। আদিম সমাজে মানুষের আহার্য সংগ্রহ করাই ছিল মৌল প্রয়োজন। আহারের অনুসন্ধানে জোটভুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতো একস্থান থেকে অন্যস্থানে। প্রকৃতির কাছ থেকে আহার্য সংগ্রহের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকালো সূচনা ঘটে। আহার্য সামগ্রী যেমন– ফল–মূল, শাক–সব্জি, পশু–পাখি ইত্যাদি ছিল অদিম মানুষের একান্ত প্রয়োজন। এ সকল খাদ্য যোগানের জন্য তাদেরকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত মানুষ সীমিত জ্ঞানের আওতায় থেকে খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়নি ততদিন সার্বিকভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতির উপর সার্বিকভাবে নির্ভরশীল মানুষের এই অবস্থাকে সমাজবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানীগণ খাদ্য সপ্তাহ বা খাদ্য আহরক অর্থনীতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ অবস্থায় সম্পত্তি বলতে প্রাকৃতিক সম্পদের ধারণাই প্রাধান্য পায়। জীবনোপযোগী যে কোন প্রাকৃতিক বন্ধু বা দ্রব্যাদি বস্তুতপক্ষে ছিল তাদের সম্পত্তি। সমষ্টিগতভাবেই তা সংগৃহীত হতো এবং তা ব্যক্তির প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করা যেত।
প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক পর্যায়ে কৃষিজীবী সমাজের প্রবর্তন হয়। বর্তমান পৃথিবীর আদিম সমাজগুলোর মধ্যে কেউ কৃষিজীবী, কেউ পশুপালক, কেউ বা একাধারে কৃষিজীবী ও পশুপালক। যে অঞ্চলে পশুপালন বা কৃষিকাজ অসম্ভব, সে অঞ্চলের এস্কিমো বা অস্ট্রেলীয় উপজাতির পক্ষে পশুপালন বা কৃষিকাজের সুবিধা ভোগ করা সম্ভব হতো না। কিন্তু তথাপি বরফের দেশে বসবাসকারী এস্কিমো এবং মধ্য অস্ট্রেলিয়ার উপর মরুভূমিতে বসবাসকারী উপজাতিরা প্রকৃতির যৎসামান্য অবদানের বিচক্ষণ সদ্ব্যবহার করে বেঁচে আছে। পরিবেশগত তারতম্যের ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রেও তারতম্য ঘটেছে। সে কারণে মানুষের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি এবং বিভিন্ন উপযোগ আহার্য ও বস্তুর উপর নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। এর সাথে মানুষের সম্পর্কিত ধারণা ও মালিকানার স্পৃহা জড়িত।
আদিম অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা তখন নির্ভর করতো তাদের ব্যবহৃত জিনিসের উপর; যেমন– তীরধনুক, পাথরে নির্মিত অস্ত্র, হাঁড়ি–কুড়ি ইত্যাদি। শ্রম বিভাগের তারতম্য অনুযায়ী এগুলো তাদের ছেলেমেয়েরা বা গোষ্ঠীভুক্ত অন্যান্য সকলে ব্যবহার করতো। কিন্তু অপরপক্ষে সামাজিক নৃবিজ্ঞানীগণ দেখিয়েছেন যে, আদিম সমাজে সম্পত্তির মালিকানা ছিল গোষ্ঠীগত, যেমন– আদিম সমাজে শিকারি জীবনের স্তরে শিকারের এলাকা ছিল গোষ্ঠী মালিকানাধীন। শিকারি জীবনে কেউ কোন পশু শিকার করে একা ভোগ করতো না। গোষ্ঠীর সকলকে তার ভাগ দিতে হতো। যদি কেউ শিকার করা পশুপাখির মাংস একা খাবার চেষ্টা করতো তাহলে তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিযুক্ত করা হতো এবং শাস্তি প্রদান করা হতো। এখনো দেখা যায় যে, মেরু প্রদেশে খাদ্য ও উৎপাদনের মাধ্যমগুলোকে পরস্পরের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়।
অনেক সামাজিক নৃবিজ্ঞানীগণ আদিম সমাজ গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মার্কসবাদীগণ আদিম সাম্যবাদী সমাজ সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছেন তা সর্বক্ষেত্রে গ্রহণীয় নয়। কারণ আদিম সমাজে কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের, পারিবারিক, ব্যক্তিগত অথবা গোষ্ঠী মালিকানাভুক্ত সম্পত্তির বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন– পরিবারের ব্যবহৃত অস্ত্র, হাঁড়ি–কুড়ি, পশুর চামড়া ও হাড় ইত্যাদি। মেয়েদেরও শিকারির নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে স্বীকৃত ছিল। ফলে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা নেই একথা সর্বক্ষেত্রে গ্রহণীয় নয়। তাছাড়া আদিম অধিবাসীদের আচার– অনুষ্ঠানসমূহের আলোচনা প্রসঙ্গে লোঈ বলেন যে, উৎপাদন ব্যবস্থার সর্ব আদি স্তরে অর্থাৎ পশু ও মৎস্য শিকার বা ফলমূল সংগ্রহের স্তরে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না একথা জোর করে বলা যায় না। দক্ষিণ আমেরিকার টরেস স্টেইটস দ্বীপুঞ্জের অধিবাসীরা উৎপাদন ব্যবস্থার সর্ব আদি স্তরে।
২. পশুচারণ সমাজে সম্পত্তি
আদিম মানুষ বনের পশুকে কিভাবে পোষ মানিয়ে খাদ্যের যোগান হিসেবে ব্যবহার করতে শিখল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদেরকে সুদূর অতীতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। আদিম শিকারি জীবনে কোন কোন সময়ে শিকারিদের হাতে কতক পশু জীবন্ত ধরা পড়ত। তখন আবশ্যকীয় খাদ্যের যোগান থাকলে ঐ পশুগুলোকে বেঁধে রাখতো। যে দিন শিকার জুটত না সেদিন প্রয়োজনবোধে ধৃত পশুগুলোকে বধ করে তার মাংস ভক্ষণ করতো। খাদ্যের অভাব না হলে ঐরূপ পশুগুলোকে লালন–পালনের মাধ্যমে পোষ মানান হতো। আবার অনেকক্ষেত্রে পশুগুলোও মানুষের আস্তানার আশেপাশে থেকে যায় শিকারিদের দেয়া খাবারের আশায়। এভাবে বনের পশু মানুষের পোষ মেনেছে এবং এ সকল পশুকে তাদের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
আদিম মানুষ পশুপালনের মাধ্যমে নিজের খাদ্যের একটা ব্যবস্থা আয়ত্ত করে নেয়ার পর পশুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে লাগল। ভেড়া ও গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে অবস্থা এরূপ দাঁড়াল যে, প্রতি বছর এদের দুধ ও মাংস খাবার পরও এদের সংখ্যা বাড়ে বৈ কমে না। এছাড়া পশুর চামড়া ও পশম দ্বারা বস্ত্র ও তাঁবু তৈরি হলো। কিন্তু পশুর সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেতে থাকল, তখন তাদের সমস্যা হলো শত শত পশুর খাদ্য যোগানের। কিন্তু স্থায়ী আস্তানায় থেকে শত শত পশুর খাদ্য যোগানো হলো অসম্ভব। কাজেই তারা তৃণভূমির সন্ধানে পশুপাল নিয়ে এক আস্তানা ত্যাগ করে অন্য আস্তানায় চলে যেতে বাধ্য হলো। সেখানকার তৃণাদি নিঃশেষ হলে আবার অন্যত্র তৃণভূমির খোঁজে যেতে হতো। সেকালের পশু পালনরত ভ্রাম্যমাণ আদিম মানবগোষ্ঠীই পরবর্তীতে ‘যাযাবর জাতি হিসেবে পশুচারণ সমাজের ভিত গঠন করে।
সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা পশুপালন এই যাযাবরদের জীবনেই সর্বপ্রথম ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা জন্মায় এবং এ অবস্থা থেকেই তা স্বীকৃত হতে থাকে। এ স্তরের সমাজব্যবস্থাতে বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমেও ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রচলন ঘটে। অবশ্য বিনিময়ের মান সমবণ্টনের বা সমমূল্যমানের উপর নির্ভর ছিল না। কেবল প্রয়োজন পূরণের স্বার্থই এ বিনিময়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল। এভাবে পশুরে সম্পদ হিসেবে গণ্য করে পশুচারণ সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব হয়। এর সাথে পশু শিকারের ও বন্য জীবজন্তুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তৈরি হাতিয়ারগুলোও ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হতে লাগল।
৩. কৃষি যুগে সম্পত্তি
যাযাবর পর্যায়ে মানুষের সামাজিক স্তর পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে সক্ষম হয়নি। কারণ তাদের জীবন কোথাও নির্দিষ্টভাবে কাটতো না। সকল সম্প্রদায়ে কৃষি ও পশুপালন চালু ছিল, কৃষির সঙ্গে ধাতুবিদ্যার সমন্বয়ের ফলে তারা ক্রমশ যাযাবর জীবন ত্যাগ করে। কৃষিতে ধাতুবিদ্যার সুষ্ঠু প্রয়োগের ফলে প্রতিটি সম্প্রদায়ে দু‘দল লোকের উদ্ভব হয়েছিল গ্রামবাসী একদল লোক কৃষিকাজ নিয়ে রইল, আর শহরবাসী একদল লোক এক একটি বিশেষ পেশায় নিয়োজিত হলো। কৃষি এবং ধাতুবিদ্যা চালু হওয়ায় জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ খাদ্য উৎপাদনের কাজ থেকে অব্যাহতি পেয়ে বিলাসদ্রব্য উৎপাদনে নিয়োজিত হলো। অর্থাৎ শিল্পকর্মী, কারিগর শ্রেণি গড়ে উঠতে লাগলো। এদিকে পশুপালন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেল এবং নব লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে পশুর বড় বড় পাল রাখা সম্ভব হলো। পরিণামে পোষা জন্তুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। ফলে অচিরেই মালিকানার প্রশ্ন দেখা নিল। কৃষি ভূ–স্বামী ও গবাদি পশুর মালিকের ছদ্মবেশে এবং কারিগরকে শোষণের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মালিকানার সূত্রপাত হলো। মার্কসবাদী তত্ত্ববিদদের মতে, ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতাগুলোতে সর্বপ্রথম তথাকথিত ‘পুরোহিত রাজা‘ শ্রেণির উত্থান ঘটে। এই প্রবল পরাক্রান্ত সামাজিক শ্রেণি নিজস্ব সম্পত্তি ও সুযোগ–সুবিধা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আইন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে।
আরও পড়ুন: কৃষিভিত্তিক সমাজ কাকে বলে? কৃষিভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য
মানুষ যখন নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করে জীবিকানির্বাহ আরম্ভ করলো তখন পশুকে কৃষিকার্যে ব্যবহার করলো এবং তখন থেকেই মানবসমাজের স্থায়িত্ব আসে।
এ স্থায়ী পরিবেশে মানুষ যখন জীবিকার জন্য কৃষিকাজ আরম্ভ করলো তখন থেকেই ভূমিতে মালিকানার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভূমি সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হলো। প্রথমে সম্প্রদায়গত ও যৌথ এবং পরে ভূ–স্বামীর ব্যক্তিগত মালিকানার রূপ লাভ করলো। কোন সম্প্রদায় কোন একটি অঞ্চল জুড়ে বসবাস আরম্ভ করলে সে স্থান সে সম্প্রদায়ের অধিকারে বা দখলে থাকতো। এভাবে ধীরে ধীরে মানবসমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা ভূ–সম্পত্তির উপর অধিকার স্বীকৃত হলো। ভূ–সম্পত্তির উপর মানুষের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কৃষি যুগে শ্রমবিভাগ দেখা দিল। যারা ভূ–খণ্ড অধিকার করতো তারা সকলেই জমি চাষাবাদ করতে পারতো না। ফলে জমি চাষাবাদের জন্য শ্রমিক নিযুক্ত করতে হতো। এভাবে কৃষিকাজে শ্রমের চাহিদা বেড়ে যাবার ফলে বাড়তি শ্রম নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিল। কৃষি উৎপাদনে শ্রম নিয়োগের জন্য দাস প্রথার উদ্ভব ঘটলো। সেকালে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে ভূ–সম্পত্তি দখল নিয়ে যুদ্ধ বাধার ফলে যারা পরাজিত হতো সেই পরাজিত গোষ্ঠী বা অধিকৃত অঞ্চলের লোকদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এ দাসগণ দলপতির ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হতো। দাসদেরকে যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করা আরম্ভ হলো তখন ভূ–সম্পত্তির মালিকগণ সমাজের অধিপতি হিসেবে উচ্চাসন দখল করলো। তারা তাদের সুবিধার্থে সম্পত্তির ব্যাপারে কতকগুলো রীতিনীতির প্রচলন করলো। দাস ও সাধারণ গরিব কৃষকদের সাথে ভূমি মালিকানার দাবিতে ভূ–স্বামী নতুন চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে উদ্ভব হলো সামন্ত প্রথা। সামন্ত সমাজের সামন্ত প্রভু ভূমিদাসদের কৃষিকাজে নিযুক্ত করতো। সামন্ত প্রথার ফলে সমাজে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পত্তির গুরুত্ব দেখা দিল। তাছাড়া ব্যক্তিমালিকানায় স্বীকৃত সম্পত্তি সামন্তবাদী সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিল। এভাবে কৃষি যুগে অর্থনেতিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে দাস, সামন্ত ও ধনতন্ত্র– এ তিনটি সমাজকাঠামো গড়ে উঠল।
৪. আধুনিক সমাজে সম্পত্তি
কৃষি যুগে সমাজে দাস ও সামন্ত প্রথা যখন চরম আকার ধারণ করলো তখন সমাজে গৃহ শিল্প গড়ে উঠলো। সমাজে ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া উৎপাদন ও ভোগ বণ্টনের উপর অধিকার স্থাপন করলো। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর বিরাট ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো থেকেই ধনিক শ্রেণির মূলধন সঞ্চয় শুরু হয়। এ অবস্থায় পুঁজিবাদের কেবল শিশুকাল। মার্কসীয় অর্থনীতি শাস্ত্রে সাম্রাজ্যবাদ বলতে পুঁজিবাদের অগ্রগতির একটি নির্দিষ্ট স্তরকে বুঝায়। একচেটিয়া পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের সর্বোচ্চ এবং সর্বশেষ স্তর। মার্কসীয়দের মতে, বিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজিবাদ। এ একচেটিয়া পুঁজিবাদ রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। অর্থাৎ এ শতাব্দীর পুঁজিপতিগণ ব্যবসায়িক পুঁজি সংযুক্ত করে বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৃহৎ শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তোলে ।
কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী এ মত সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেননি। বৃহদায়তন শিল্প প্রচেষ্টা অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, সকল শিল্পসমৃদ্ধ দেশেই কমবেশি পরিলক্ষিত হয়। সে সকল দেশে সম্পত্তির মালিকানা কিছু সমষ্টিগত, কিছু যৌখ, কিছু ব্যক্তির নিজস্ব এবং কিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হতে পারে।
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে, আমেরিকায় ও পরে অন্যতম উৎপাদন ব্যবস্থায় যে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটলো এর ফলে সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন দেখা দিল। প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবি এ আমূল পরিবর্তনকে ‘শিল্পবিপ্লব‘ নামে আখ্যায়িত করেন। ১৭৬৯ সালে জেমস ওয়াট (James Watt) বাষ্পীয় শক্তি আবিষ্কার করেন। বাষ্পীয় শক্তি আবিষ্কারের পর যন্ত্রযুগের দ্রুত বিকাশ হতে লাগলো। এতে যেমন বৃদ্ধি পেল বিবিধ শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন, তেমনি বৃদ্ধি হলো আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্যের পরিমাণ। শিল্পজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে বণিক শ্রেণি সমাজে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে বসলো। ফলে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে লাগলো। পুঁজিপতিরা ক্রমান্বয়ে বহির্বিশ্বে তাঁদের ব্যবসায় সম্প্রসারিত করলো। এর ফলে সম্পত্তির উপর অধিকার পুঁজিপতির করায়ত্ত হতে লাগলো। বৃহৎ শিল্পের মালিকানা লাভের সাথে সাথে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ তাদের অধিকারে চলে গেল। সমাজে এল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যান্ত্রিক উৎপাদন এবং এখানেই শ্রমশিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। সেজন্য শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী যুগকে শ্রমশিল্প যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শ্রমশিল্প যুগকে সাধারণত দু‘ভাগে ভাগ করা হয়েছে— ক. পুঁজিবাদী ও খ সমাজতান্ত্রিক। মার্কসবাদীরা এর সাথে আরো এক যুগের সংযোগ করেন; তা হলো গ. সাম্যবাদী সমাজ।
মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়ে তোলার ও ব্যবসায়–বাণিজ্যের দ্বারা অবাধ মুনাফা অর্জনের স্বাধীনতা যে সমাজে স্বীকৃত সে সমাজকে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক সমাজ বলে ।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল দ্বন্দ্ব হলো সামাজিক উৎপাদনের সঙ্গে ব্যক্তিগত মালিকানার দ্বন্দ্ব। পুঁজিবাদী সমাজে দেখা যায়, ব্যক্তিগত ভোগদখল আর সামাজিক উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পথ রুদ্ধ। সেজন্য মনে করা হয় যে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যেই পুঁজিবাদের ধ্বংসের বীজ নিহিত।
৫. সমাজতান্ত্রিক সমাজে সম্পত্তি
ধনতন্ত্রের পরবর্তী স্তর হচ্ছে সমাজতন্ত্র । ধনতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার পর শ্রমিক শ্রেণি শোষক ও শোষণবিহীন একটি নতুন সমাজ নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করে।
সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা সম্বন্ধে বিশেষ মতভেদ থাকলেও বলা যায় যে, এ উৎপাদনের উপকরণসমূহের সামাজিক মালিকানা ও ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল সমাজব্যবস্থা। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের মূলে রয়েছে উৎপাদনী উপায়গুলোর উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বিলোপ ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। এ পর্যায়ে (সমাজতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থায়) “সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকে কাজ করবে, প্রত্যেকে তার কাজ অনুযায়ী মঞ্জুরি পাবে।” সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনী উপায়গুলো আর পুঁজি বা মূলধন হিসেবে কাজ করে না, অর্থাৎ এরা আর শোষণের উৎস হিসেবে গণ্য হয় না। সমাজতন্ত্রে সঞ্চিত শ্রমকে আর স্থির ও পরিবর্তনশীল পুঁঞ্জি বলে মনে করা চলে না। সমাজে সঞ্চিত শ্রমের সমগ্র পরিমাণ অর্থাৎ উৎপাদন ও ভোগের সমগ্র উপায়গুলো) তখন সমাজের হাতে চলে আসে: আরো উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে লাগে, জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষিত হয়। কিন্তু সকল ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা সম্ভব হয় না। গ্রামে গ্রামে বৃহৎ ও মূল শিল্পগুলোর সামাজিকীকরণ করা হয় এবং ধীরে ধীরে ছোটখাটো কৃষিখামার ও শিল্পগুলোকে সমবায়ের ভিত্তিতে যৌথ মালিকানায় নেয়া হয়। সেজন্য দেখা যায় সমাজতান্ত্রিক সমাজে সম্পত্তি দুটি রূপে অবস্থান করে;
ক. রাষ্ট্রীয় বা সরকারি এবং
খ. সমবায়ী এবং যৌথ বা সমষ্টিগত কৃষি সম্পত্তি।
রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি সমগ্র জনগণের সম্পত্তি কিন্তু ব্যবহারের জন্য শ্রমিক–কৃষকের সরকার বা রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত, তার কাছে যেন গচ্ছিত রাখা। আবার সমবায়ী বা যৌথ কৃষি ফার্মের সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি পৃথকভাবে প্রতিটি কৃষি সমবায় বা সমবায়ী ইউনিয়নের সম্পত্তি। দুটি ধরনের সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি ইতিহাসের বিশেষ অবস্থা থেকে উদ্ভব হয়েছে। সমাজতন্ত্র নির্মাণ সব দেশে একই অবস্থার মধ্য দিয়ে আসে না। বিশেষ বিশেষ অবস্থার চাপ তাই বিশেষ বিশেষ ধরনের সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি তৈরি করে। সম্পত্তির রূপের উপরে ছাপ সুস্পষ্ট। সমাজতান্ত্রিক নীতিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর দু‘ধরনের সম্পত্তি রাষ্ট্রের সম্মুখে এসে পড়ে। একদিকে বৃহৎমাত্রার পুঁজিতান্ত্রিক সম্পত্তি, এর ভিত্তি হলো ভাড়া করা মজুর খাটানো ও শোষণ করা এবং অন্যদিকে থাকে ব্যক্তিগত শ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত চাষি, কারিগর ও হস্ত শিল্পীদের ক্ষুদ্রমাত্রা সম্পত্তি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এই বিপ্লবের একটি ধারা হিসেবে বৃহৎমাত্রায় পুঁজিতান্ত্রিক সম্পত্তিগুলোই হস্তান্তরিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিকানায় চলে আসে। এভাবে দেখা দেয় রাষ্ট্রীয় বা সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি।
সমাজতান্ত্রিক মালিকানা বলতে বুঝায় জনগণের একত্র ও মিলিত মালিকানা, সর্বজনীন মালিকানা। সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথা বিলোপ সাধনের ফলে কোন ব্যক্তির পক্ষেই অনুপার্জিত আয় আহরণের সম্ভাবনা আর থাকে না এবং শ্রমই তখন জীবনধারণের একমাত্র উপায়, সমাজে ব্যক্তির স্থান বা গুরুত্বের একমাত্র মাপকাঠি তার শ্রমের ধরন ও পরিমাণ। সমাজতন্ত্রে সামাজিক মালিকানা প্রসারিত থাকে কেবল উৎপাদনী উপায়গুলো পর্যন্ত এবং সরকারি ও সমবায়ী উদ্যোগে উৎপন্ন দ্রব্যসামন পর্যন্ত। উৎপন্ন এ দ্রব্যসামগ্রীর একটি অংশ পরবর্তীকালে আবার উৎপাদনের উপায় পরিণত হয় এবং তারা সামাজিক সম্পত্তিই থেকে যায়। অপর অংশটিতে থাকে ভোগ্য দ্রব্যাদি, এগুলো শ্রমের পরিমাণ ও গুণ অনুসারে শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং শ্রমজীবী জনসাধারণের নিজস্ব বা স্বীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে পড়ে।
মার্কসবাদীদের মতে, সমাজতন্ত্রের পরবর্তী স্তর সাম্যবাদ। এ পর্যায়ে “সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকে কাজ করবে, প্রত্যেকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সুযোগ–সুবিধা পাবে।” এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, সমাজের উচ্চতর স্তরে জনগণকে আর শ্রম বিভাগের দাস থাকতে হয় না। মানুষ তখন মাত্র জীবিকার্জনের জন্য কাজ করবে না, করবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবনের প্রধানতম অনুপ্রেরণা বলে।