ইতিহাসের বিষয়বস্তু
মানুষ, তার সমাজ ও মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত অতীত কর্মের প্রামাণ্য দলিল হল ইতিহাস। ইতিহাস মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে সঠিক ও সুবিন্যস্তভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে। এর বিষয়বস্তু অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে অনেক ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতপক্ষে মানুষ কর্তৃক অবলম্বিত, রচিত, সৃষ্ট, নির্মিত, আবিষ্কৃত, বিবৃত, ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং ঐতিহাসিক কর্তৃক ঐ বিষয়ের ওপর যথাযথভাবে লিখিত সকল অতীতই ইতিহাসের বিষয়বস্তু । যেমন-
১. মানুষের উৎপত্তি ও বিবর্তন
ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে সর্বাগ্রে মানুষের উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তনকে উল্লেখ করা যায়। কখন কীভাবে মানুষের উৎপত্তি হল এবং কোন্ কোন্ পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে মানুষ আজ বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তা ইতিহাসের বিশেষ উপজীব্য। ইসলাম ধর্মের আলোকে মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে নীচু শ্রেণীর প্রাণী থেকে মানুষের ক্রমবিকাশ ঘটেছে। প্রাপ্ত দেহাবশেষ বা ফসিল বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে। যাহোক জাভা মানব, পিকিং মানব, নিয়ান্ডার্থাল মানব থেকে শুরু করে কমপক্ষে যে তিনটি দৈহিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে আদিম অবস্থা থেকে মানুষের আধুনিক আবস্থায় রুপান্তর ঘটেছে সেসবই ইতিহাসের বিষয়বস্তু ।
২. সভ্যতার ক্রমবিবর্তন
সভ্যতার ক্রমবিবর্তন ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। আদি গুহাবাসী মানুষ কী করে জীবনধারণ করত, তাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য ফল ও শিকারী পশুর ওপর নির্ভরতা এবং তাদের গুহাচিত্র থেকে শুরু করে বিশ্বের সকল সভ্যতার ক্রমবিবর্তন ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়। মানব সভ্যতা নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আজ উৎকর্ষের যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সে সম্পর্কে আলোচনা করাও ইতিহাসের বিষয়। আদি গুহাবাসী এবং গেছো মানুষের সমাজ ও জীবনযাত্রা, সুমেরীয় সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতাসহ সকল প্রকার সভ্যতা এবং এগুলোর ক্রমবিবর্তন ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু
৩. ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশ
ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর মধ্যে ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মানুষ ও তার বিভিন্ন পরিবেশের সাথে অবিরত সংগ্রামই হল ইতিহাসের মূলভিত্তি। এক কথায় মানুষ ও তার পরিবেশ হল ইতিহাসের মূলকথা। প্রয়োজন অনুসারে মানুষ নিজ উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে কীভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিবর্তন করে থাকে, অপরদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের জীবনধারণ প্রণালী, রীতিনীতি ও সভ্যতাকে কীরূপে প্রভাবিত করে তা ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় ।
৪. যুগ বিভাজন
ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রম যেমন ইতিহাসের মূলসূত্র, তেমনি যুগ বিভাজন ইতিহাসের অপরিহার্য আলোচ্য বিষয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ, প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ, ঐতিহাসিক যুগ তথা পুরাতন প্রস্তর যুগ, মধ্য প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ (নবোপলীয় বিপ্লব), তাম্রপ্রস্তর যুগ, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ ইতিহাসের বিশেষ বিষয়বস্তু ।
৫. প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
হাজার বছরের পুরাতন ও জরাজীর্ণ দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, শিলালিপি, মুদ্রা প্রভৃতি ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় । যেমন— সিন্ধু সভ্যতার নগরভিত্তিক স্থাপত্যকর্ম, চীনের মহাপ্রাচীর, হাম্মুরাবির আইন সম্বলিত ব্যাবিলনের সিপার, মিসরের রোজেটা পাথর প্রভৃতি ইতিহাসের বিষয়বস্তু । প্রাচীন বাংলার পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার, কুমিল্লার আনন্দ বিহার, মহাস্থানগড়ের দূর্গের বিশাল প্রাচীর, মহাস্থানগড়ের দক্ষিণ দিকের সুউচ্চ ঢিবি (তথাকথিত বেহুলা-লক্ষীণদরের বাসরঘর) প্রভৃতি ইতিহাসের উপজীব্য।
৬. সামাজিক ক্রমবিবর্তন
আদি মানবগোষ্ঠীর সাম্যবাদী সমাজ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত সমাজ ব্যবস্থায় যে ক্রমপরিবর্তন হয়েছে তা ইতিহাসের বিষয়বস্তু । যেমন- একেবারে আদি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, রাজতান্ত্রিক সমাজ, একনায়কতান্ত্রিক সমাজ, স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ, গণতান্ত্রিক সমাজ, ফ্যাসিবাদী সমাজ (ইতালি), নাৎসীবাদী সমাজ (জার্মানি), সাম্যবাদী সমাজ (রাশিয়া, চীন, কিউবা) প্রভৃতি সামাজিক ক্রমপরিবর্তন ইতিহাসের বিষয়বস্তু । আদিম সমাজের ক্ল্যান সংগঠন ও ট্রাইব হতে শুরু করে আমাদের আজকের সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও সংগঠনও ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
৭. অর্থনৈতিক প্রভাব ও সংগঠন
অর্থসম্পদ মানুষের জীবনের বিশেষ প্রয়োজনীয় দিক। বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তায় ইহা মানুষ ও ইতিহাসের গতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। উল্লেখ্য, প্রাচীন ফিনিসীয়রা ব্যবসা- বাণিজ্যের সাথে সাথে সভ্যতার নানা উপাদান এক স্থান হতে অন্যস্থানে বয়ে নিয়ে গিয়ে সভ্যতার প্রচারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মধ্যযুগের গিল্ড প্রথা, মধ্যযুগে ইউরোপে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্ভব ও সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি প্রভৃতি ইতিহাসের বিষয়বস্তু। বিশ্বখ্যাত আমেরিকান বিপ্লব (১৭৭৬), ফরাসি . বিপ্লব (১৭৮৯), রুশ বিপ্লব (১৯১৭) ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনেও রয়েছে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কারণ- যা ইতিহাসের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়বস্তু। তাছাড়া জার্মানির একত্রীকরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী সংগঠন জোলভেরেইন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (সাবেক EEC), দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ASEAN প্রভৃতি অর্থনৈতিক সংগঠনও ইতিহাসের বিষয়বস্তু ।
৮. ধর্মীয় ক্রমবিকাশ
ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ, বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক, ধর্মীয় সম্প্রদায়, ধর্মীয় সংঘাত প্রভৃতি ইতিহাসের বিষয়বস্তু । হযরত মুসা (আঃ) প্রচারিত ইহুদি ধর্মের নানাদিক, গৌতমবুদ্ধ প্রচারিত বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দিক, হযরত ঈসা (আঃ) প্রচারিত খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রচারিত ইসলাম ধর্মের অনুসারী ও এ ধর্মের নানা সম্প্রদায় ইতিহাসের বিষয়বস্তু । তাছাড়া ইউরোপের Holy Roman Empire, ধর্মসংস্কার আন্দোলন, প্রতিসংস্কার আন্দোলন, ত্রিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৬১৮–১৬৪৮) প্রভৃতি ধর্ম সংক্রান্ত দিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
৯. অতীতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড
ইংরেজ ঐতিহাসিক Freeman ইতিহাসকে Past Politics বলে অভিহিত করেন। তাহলে তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, অতীতের সকল রাজা-বাদশা, সুলতান, সম্রাট, গভর্নর প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষেই প্রাচীন সুমেরীয় সম্রাট ডুঙ্গি, রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও তাদের কার্যাবলি ইতিহাসের বিষয়বস্তু । ডুঙ্গির বিখ্যাত আইন, অগাস্টাস সিজারের গৌরবময় শাসনকাল, নেপোলিয়নের বিখ্যাত সংস্কারসমূহ ও বিজয় অভিযানগুলোর মত অতীতের সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তাদের সূচিত পদক্ষেপসমূহ ইতিহাসের বিশেষ উপজীব্য।
১০. সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
পৃথিবীর সকল জাতিরই কমবেশি একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আদি গুহাবাসী মানবের অঙ্কিত গুহাচিত্র ও পারিবারিক বিভিন্ন আচারানুষ্ঠান ইতিহাসের বিষয়বস্তু । বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য, লিপি, ভাস্কর্য, কারুশিল্প ও চারুশিল্প বিচার বিশ্লেষণ করে ইতিহাস স্বীয় কলেবর স্ফীত করে। সুতরাং এ সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইতিহাসের বিষয়বস্তু। প্রকৃতপক্ষে একটি জাতির সাংস্কৃতিক দিক সম্পর্কে না জানতে পারলে সে জাতির সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা সম্ভবপর নয়। কারণ সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির সভ্যতা ও উৎকর্ষতা পরিমাপের মূল একক। আদি গুহাবাসী মানব গুহাভ্যন্তরে যে সকল চিত্র অংকন করত তার অধিকাংশই ছিল বর্শাবিদ্ধ ও মানুষ কর্তৃক আক্রান্ত পশুচিত্র। এ চিত্র থেকে ধারণা করা যায় যে, শিকারে বের হওয়ার পূর্বে হয়ত তারা বর্শাবিদ্ধ বা মানুষ কর্তৃক আক্রান্ত শিকারী পশুর ছবি অংকন করত। হয়ত তাদের ধারণা ছিল এরূপ করলে শিকার করা সহজ ও সফল হবে। প্রাচীন ব্যাবিলনীয়দের সৌধ, মাটির দ্রব্য, ঝুড়ি, পশুচিত্র, প্রাচীন মিসরীয়দের চমৎকার চিত্রকলা, প্রাচীন বাংলার পাল ও সেন যুগের ভাস্কর্য, চিত্র ও নানা প্রকার মূর্তি থেকে শুরু করে মুঘল, ইংরেজ, পাকিস্তানি আমল ও বর্তমান বাংলাদেশের সকল প্রকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইতিহাসের পাতায় স্থান লাভ করেছে। সুতরাং বলা যায়, আদি গুহাবাসী মানবের সাংস্কৃতিক জীবন থেকে শুরু করে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সকল দেশের সকল মানুষের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে ইতিহাস পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। অতএব, এ সব সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ অবশ্যই ইইতিহাসের বিষয়বস্তু ।
১১. নদনদী ও সমুদ্র
নদনদী ও সাগর-মহাসাগর ইতিহাসের বিষয়বস্তু হতে পারে কিনা সে বিষয়ে মতভেদের অবকাশ থাকতে পারে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার পর হয়ত দেখা যাবে যে, নদনদী ও সাগর-মহাসাগরও ইতিহাসের বিষয়বস্তু হতে পারে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর সবই নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠেছিল। যেমন- নীলনদের তীরে মিসরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমীয় সভ্যতা, হোয়াংহু নদীর তীরে চৈনিক সভ্যতা, সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা প্রভৃতি। কাজেই দেখা যায়, সভ্যতা গড়ে তুলতে নদনদীর ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে পলিমাটি পড়ে উর্বর হয় এবং এ উর্বর মাটিতে ভাল ফসল ফলে। যে কারণে প্রাচীন যুগের মানুষ নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে ও সভ্যতা গড়ে তোলে। তাছাড়া পানীয় জল ও ব্যবসায়িক মালামাল পরিবহনেও নদীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য বহুসংখ্যক নদনদী ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
আরও পড়ুন: ইতিহাস শব্দের উৎপত্তি এবং ইতিহাসের সংজ্ঞা দাও
১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর অর্থাৎ তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ যখন খ্রিস্টানদের কাছ থেকে কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে নেন তারপর শুরু হয় ভৌগোলিক আবিষ্কারের। যার ফলে নতুন দুনিয়া অর্থাৎ আমেরিকা আবিষ্কার হয়। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কলম্বাস, জন ক্যাবট, ভাস্কো-দা-গামা যে পথ ব্যবহার করে ভৌগোলিক আবিষ্কারকে সাফল্যমণ্ডিত করেন তাহল ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও ইতিহাস সৃষ্টিতে সাগরের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন সমুদ্রপথে অবরোধ সৃষ্টি করেই ইংল্যান্ডকে ঘায়েল করার জন্য মহাদেশীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এখানেও সমুদ্র ইতিহাসে নতুন মাত্রা সংযোজিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অতএব বলা যায়, নদনদী ও সাগর- মহাসাগর তার তীরে সভ্যতার জন্ম দিয়ে, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ভৌগোলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়।
১২. লেখক, দার্শনিক, আবিষ্কারক ও তাঁদের কর্ম
ইতিহাসের বিষয়বস্তু এত বিস্তৃত যে প্রকারান্তরে সকল লেখক, দার্শনিক, আবিষ্কারক এবং তাঁদের লেখনী, বিভিন্ন তত্ত্ব ও আবিষ্কার এর আওতাভুক্ত। ইতিহাসের সূচনা মূলত গ্রিসদেশে এবং ইতিহাসের জনক নামে খ্যাত হিরোডোটাসও ছিলেন গ্রিসের। একজন লেখক হিসেবে তিনি নিজেও ইতিহাসের বিষয়বস্তুর মধ্যে পড়েন।
তেমনিভাবে গ্রিক কবি হোমার এবং তাঁর কাব্য ইলিয়াড ও ওডিসি, দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, কনফুসিয়াস ও তাদের তত্ত্বাবলি ইতিহাসের বিষয়বস্তু । একইভাবে বলা যায়, গণিতবিদ ইউক্লিড, জ্যোতির্বিদ হিপার্কাস, বৈজ্ঞানিক আর্কিমিডিস, নিউটন ও তাঁদের আবিষ্কার ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়ের অন্ত র্ভুক্ত। সর্বোপরি নবোপলীয় যুগে আগুন জ্বালাবার কৌশল আবিষ্কার, পশুপালন পদ্ধতির উদ্ভাবন, কৃষি পদ্ধতি উদ্ভাবন ও চাকার আবিষ্কার প্রভৃতি ইতিহাসের বিষয়বস্তু ।
১৩. সংস্কার ও সংস্কারক
পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের মধ্যদিয়ে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো ক্রমশ পরিপূর্ণতা লাভের দিকে এগিয়ে যায়। আদিম পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো যুগের পর যুগ অসংখ্য সংস্কারক কর্তৃক সংস্কার সাধনের ফলেই বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। পৃথিবীতে মানুষের আগমনের পর হতে আজকের উন্নততর সভ্যতা গড়ে তোলা পর্যন্ত যত সংস্কারকের আগমন ঘটেছে তাঁরা সকলেই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় এবং তাঁদের ইতিবাচক বা নেতিবাচক সকল সংস্কার কর্মও ইতিহাসের উপজীব্য। এক্ষেত্রে ধর্ম সংস্কারক, সামাজিক সংস্কারক, অর্থনৈতিক সংস্কারক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারক এবং সাংস্কৃতিক সংস্কারকসহ সকল প্রকার সংস্কারক ও তাঁদের সকল সংস্কারকর্মকে ইইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
১৪. উত্থান-পতন
মানুষ ও সভ্যতার সূচনা হতে শুরু করে পৃথিবীর সকল জাতি, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রের উত্থান-পতন ইতিহাসের বিষয়বস্তু । কী কারণে একটি জাতি ও সভ্যতার উত্থান ঘটেছে এবং কী কারণে আবার ঐ জাতি ও সভ্যতার পতন ঘটেছে তা আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি। বিশ্বের সকল শাসক ও রাজবংশ কী করে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের রাজত্বকাল কেন শেষ হয়েছে- তা ইতিহাসের বিষয়বস্তু । সুতরাং বলা যায়, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র, শাসক ও রাজবংশের যাবতীয় উত্থান-পতন ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়।
১৫. আন্দোলন ও যুদ্ধবিগ্রহ
যেকোন দেশ ও জাতির সকল রাজনৈতিক সমস্যা এবং এতদসংক্রান্ত যাবতীয় আন্দোলন ইতিহাসের বিষয়বস্তু । তাছাড়া সামাজিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ধর্মীয় আন্দোলন প্রভৃতি সকল আন্দোলন ইতিহাসের উপজীব্য। তদুপরি সকল গৃহযুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের নগ্নরুপ, স্নায়ুযুদ্ধসহ সকল প্রকার সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহের বিবরণ ইতিহাসের বিষয়বস্তু ।
১৬. সম্মেলন ও চুক্তি
সকল প্রকার স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষে আহুত সম্মেলন ও চুক্তি ইতিহাসের ..বিষয়বস্তু। তাছাড়া যেকোন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভাও ইতিহাসের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। যেমন- ওয়ার্মসের সম্মেলন (১৫২১), ভিয়েনা সম্মেলন (১৮১৫), প্যারিস শান্তি সম্মেলন (১৯১৯), নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন (১৯৩২-৩৩) প্রভৃতি ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছোটবড় সকল প্রকার অন্তঃরাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তিসহ বিভিন্ন চুক্তিও ইতিহাসের বিষয়বস্তু । যেমন- ব্রিটেনের ম্যাগনা কার্টার (১২১৫), ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিচুক্তি (১৬৪৮), বার্লিন চুক্তি (১৮৭৮) প্রভৃতি ইতিহাসের বিষয়বস্তু ।
১৭. সকল subject-এর অতীত বৃত্তান্ত
জ্ঞানচর্চার যেকোন subject এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ইতিহাসের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য, দর্শনশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা, পরিসংখ্যান, স্থাপত্যবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যাসহ সকল বিষয়ের (All subjects) কথা উল্লেখ করা যায়। কারণ এসব প্রকার subject- এর উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তনের খতিয়ান তথা অতীত বৃত্তান্ত আছে। আর অতীত বৃত্তান্ত বলতে আমরা এ সকল subject-এর ইতিহাসকে বুঝে থাকি। সুতরাং সকল প্রকার subject-এর অতীত বিবরণ ইতিহাসের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত এবং সকল প্রকার subject এক অর্থে ইতিহাসের গণ্ডিভুক্ত বিষয়।
উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বলা যায়, মানুষ, তার সমাজ, সভ্যতা, জীবনধারা ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তু। যুগযুগান্তর ধরে মানুষ তার পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে এগিয়ে চলছে। এক সময় মানুষ ছিল গুহাবাসী, সভ্যতার সর্ব নিম্নস্তরে তখন ছিল তার অধিষ্ঠান। সে মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে নিরন্তর সংগ্রাম করে সমাজ গড়েছে, খাদ্য উৎপাদন করেছে, শিল্প গঠন ও নগর নির্মাণ করে জীবনযাত্রাকে আরামপ্রদ করেছে। সুতরাং এ সবই ইতিহাসের বিষয়বস্তু । তাছাড়া বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর কার্যকলাপ, এদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, সংঘাত ও সহযোগিতা এবং যুগযুগান্তরের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের বিবরণ সবই হল ইতিহাসের বিষয়বস্তু । J. E. Swain-এর মতে “It (History) attempts to evaluate all the developments in science, in art, in literature, in philosophy, in architecture, in sociology, in politics, in war, in religion and in law. It sketches as complete a picture as possible of everything that has influenced man directly or indirectly.” অতএব দেখা যায়, মানুষ, সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ভূ-প্রকৃতি, যুগ বিভাজন, সকল আন্দোলন, যুদ্ধবিগ্রহ, চুক্তি, এমনকি পঠন-পাঠনের সকল বিষয় (All subjects) ইতিহাসের বিষয়বস্তু ।