সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা
সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিস সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা ‘Human Society’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, “এটি সুস্পষ্ট যে সমাজবিজ্ঞান পাঠের সামাজিক ও ব্যক্তিগত মূল্য আছে। এ কারণেই সমাজের উপস্থিতি যে স্বীকার করেছে তা নয় বরং একে সমর্থন জানিয়েছে।”
সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে এমন কতক সমালোচক আছেন যারা মনে করেন সমাজবিজ্ঞান জীবনের বাস্তব অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে না, কেবল মতাদর্শ ও তত্ত্ব নিয়ে পর্যালোচনা করে। এ আলোচনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বা কোন সর্বজনীন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। সমাজজীবনের ক্ষেত্রে এরূপ আলোচনার তেমন কোন গুরুত্ব নেই। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানের আদৌ কোন মূল্য আছে বলে স্বীকার করেন না। এরূপ মতবাদ প্রবক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হচ্ছেন- ভিল ফ্রেডো পেরেটো।
আরও পড়ুন: সমাজবিজ্ঞানের সাথে সমাজকর্মের সম্পর্ক আলোচনা কর।
উপরিউক্ত ধারণা সৃষ্টি হওয়ার পিছনে কেবল একটিই যুক্তি আছে তা হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক যা এখনো অনেকের কাছে সুস্পষ্টভাবে নির্ণীত হয় নি। তবে সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমিত হয় যে সমাজস্থ মানুষের কাছে এ শাস্ত্রটির আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বেশি।
সমাজবিজ্ঞানের পঠনপাঠন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিশ্বব্যাপী এতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর চর্চার বিকাশ যতটা ব্যাপকতর হওয়ার প্রয়োজন ছিল ততোটা ব্যাপকতর হয়ে উঠে নি। এর কারণ বহুবিদ। আমরা এখানে সে বিষয়ে ভাবগত ভিত্তি পরিহার করে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরব-
১. সামাজিক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও তার বাস্তবায়ন
সামাজিক জীবনধারার নিয়ন্ত্রণ ও সাফল্যের স্বার্থে সমাজবিজ্ঞান এর পঠনপাঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য যথাযথ সামাজিক নীতি নির্ধারণ এবং তার বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত উপায় বা পদ্ধতি স্থির করা দরকার। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানের ধ্যানধারণা বিশেষ সহায়ক।
বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও জটিল সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা অধিক। অধ্যাপক অগবার্ন ও নিমকফ ‘A Hand Book of Sociology’ নামক গ্রন্থে মন্তব্য করেন, “Sociology is a body of learning about society it is a description of ways to make society better. It is a social ethics a social philosophy. Generally, however, it is deemed as a science of society.” অর্থাৎ, সমাজবিজ্ঞানকে সাধারণত সমাজের বিজ্ঞান বলে মনে করা হলেও এটি হচ্ছে আসলে একটি সামাজিক নীতিবিজ্ঞান, কিংবা সামাজিক দর্শন বিশেষ যার পঠন-পাঠন সমাজকে উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য খুবই সহায়ক।
২. মানবসমাজের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা
সমাজবিজ্ঞানই মানবসমাজকে মুখ্য বিষয় হিসেবে ভিত্তি করে বিজ্ঞানসম্মত বিচার বিশ্লেষণের সুযোগ সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ তথা বর্তমান বিশ্বের সমাজব্যবস্থা বিশেষ সমস্যাসঙ্কুল। এ সমস্যার মোকাবিলায় মানবসমাজের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা প্রয়োজন। বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় অধিকতর উপযোগী মনে করা হয়।
আরও পড়ুন: সমাজবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক আলোচনা কর।
৩. মানবসমাজ সম্পর্কিত জ্ঞানের উৎস
সমাজবিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমে সমাজস্থ মানুষ তার নিজ সমাজে উদ্ভূত সমস্যাবলি সহজেই জানতে পারে। তার সমাজের প্রেক্ষাপটে কিভাবে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে বা হয়েছে সে সম্পর্কে যথাযথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানতে পারে। সমাজের কাঠামোগত সমস্যা ও সামাজিক সমস্যার উৎস কি? তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানিগণ ব্যাপক আলোচনা করেছেন। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট এসব সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে সমাজবিজ্ঞানীদের জ্ঞান এক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
৪. সামাজিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ
সমাজবিজ্ঞান মানবসমাজে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত রূপ, কর্মকাণ্ড ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব এবং সমাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিভাবে মানুষের উপকারে আসতে পারে, কী করলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের স্বার্থ সাধনে অধিকতর সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে এসব বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানের আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আধুনিক বিশ্বের সাথে সমতালে চলতে হলে বাংলাদেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য ।
৫. আর্থসামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ
সমাজবিজ্ঞান সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে সঠিক কারণ এবং প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক জ্ঞান প্রদান করে। সমাজ পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের গতি প্রকৃতি অনুধাবন ও অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার উপর তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে অবহিত হওয়া যায়। বাংলাদেশের সমাজকাঠামো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড, নাগরিকদের জীবনধারা প্রভৃতিতে পরিবর্তনের ভাব লক্ষণীয়। সমাজের গতি প্রকৃতি জানার জন্য সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে চলেছে।
৬. সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবে কার্যকর করার জন্য সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য
বাংলাদেশে সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সেই পরিকল্পনা বাস্ত বায়নের জন্য সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োজন। বাংলাদেশের সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সমাজতাত্ত্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ অপরিহার্য। সমাজবিজ্ঞান সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালিয়ে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে সমাজতাত্ত্বিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
৭. সামাজিক সমস্যার সূত্র অনুসন্ধান
বর্তমানে বিশ্ব ও বিশ্ববাসী বহু ও বিভিন্ন সমস্যার সংকটে বিপন্ন। এসব সমস্যার সমাধানের সূত্র অনুসন্ধানে সমাজবিজ্ঞানিগণ বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান ও সূত্র আবিষ্কার করে থাকেন। সমাজবিজ্ঞানিগণ মনে করেন, সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির পিছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে। সে সম্পর্কে কার্যকারণ সূত্র আবিষ্কার করাই হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্যবিষয়। সমাজবিজ্ঞানীদের আলোচ্য বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে সামাজিক সংকট নিরসনের পদক্ষেপ গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে।
আরও পড়ুন: সমাজবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর
৮. সামাজিক বিচ্যুতি ও অপরাধ দমন
সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার চলমান গতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনে দেয়। সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন, প্রাপ্তির চেয়ে প্রত্যাশার ব্যবধান, হতাশা, নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, ছিনতাই, মাদকাসক্ত এসব সমস্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সকল সমাজেই এর হিংস্র ছোবল সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এর পেছনের আর্থসামাজিক কারণ অনুসন্ধানে সমাজবিজ্ঞানিগণ বিভিন্ন গবেষণা, অনুসন্ধান এবং এর নিরাময়ে অপরাধ দমন ও সংশোধনের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশের সমাজে এসব সমস্যা মোকাবিলায় সমাজবিজ্ঞানীদের ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী।
৯. সমাজে মানুষের মর্যাদা ও তার অন্তর্নিহিত মূল্য উপলব্ধি এবং সংস্কারবোধ
সমাজস্থ মানুষের সামাজিক মর্যাদা, ব্যক্তি ও সমষ্টি হিসেবে মূল্যবোধ নির্ণয়ের বাস্তব ও যুক্তিসম্মত ধারণা কেবল সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমেই বেশি আলোচিত হয়েছে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারায় সামাজিক অসমতা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, জাতি- বর্ণ বৈষম্য, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের বর্ণ বৈষম্য প্রভৃতি সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা ও চিন্তার মাধ্যমে এসব অর্থহীন কৃত্রিম ভেদাভেদ প্রভৃতি বিষয়ে সংস্কারমুক্ত সঠিক পদক্ষেপ সমাজবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার ফলে সফল হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজের সার্বিক উন্নয়নে এ সকল সামাজিক কৃত্রিম ব্যবধান দূর করতে হলে সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন।
১০. মানব সংস্কৃতির সমৃদ্ধি সাধন
সমাজের প্রচলিত প্রথা, প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় বিশ্বাস, কুসংস্কার প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সমস্যা সংকটের সৃষ্টি হয়। এসব সংকটের মীমাংসা ও সমাধান এখন আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের ভিত্তিতে যুক্তিবাদী মন নিয়ে মীমাংসা করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বিভিন্ন সমাজ ও মানবগোষ্ঠীর মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন এথনিক মানবগোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠাকল্পে এবং মৌলিক চাহিদা মিটানোর পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য।
১১. মানসিক বিকাশ সাধন
সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁৎ ও হার্বার্ট স্পেন্সার সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞানকে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সমাজবিজ্ঞান অনুশীলনে মানুষের বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান অর্জন এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারিত হয়। সেজন্য মানুষের মননশীলতার উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রেও সমাজবিজ্ঞানের অনুশীলনের অবদান