এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যা তত্ত্ব বেশ আলোচিত একটি তত্ত্ব। এই তত্ত্বে এমিল ডুর্খেইম সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আত্মহত্যা বিষয়টিকে আলোচনা করেছেন। আজকের আর্টিকেলে এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যা তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরব।
এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যা তত্ত্ব বর্ণনা
ডুর্খেইমের ‘Le Suicide‘ গ্রন্থটি ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয়। ‘Suicide’ নামে জর্জ সিম্পসন গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। ডুর্খেইম সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘আত্মহত্যা’ বিষয়টিকে আলোচনা করেছেন। সামাজিক সংহতি বিনষ্টকারী শক্তিসমূহ নিয়ে গবেষণাকালে আত্মহত্যা বিষয়টিকে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন। ডুর্খেইম আত্মহত্যাকে সামাজিক সংহতির সূচকরূপে তাঁর গবেষণায় ব্যবহার করেন এবং তিনি বিভিন্ন দেশের আত্মহত্যার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবরণ ও বিশ্লেষণ প্রদান করেন। বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিকদের চেয়ে প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে, বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিতদের মধ্যে, বেসামরিক ব্যক্তিদের চেয়ে সৈনিকদের মধ্যে, যুদ্ধ বা বিপ্লবের সময়ের চেয়ে শান্তির সময়ে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নতর অবস্থায় অথবা অর্থনৈতিক মঙ্গা বা মন্দাবস্থার সময়ে আত্মহত্যার হার উচ্চতর লক্ষ্য করেছেন। তবে সামাজিক চাপ বা নেতিবাচক সামাজিক ঘটনাকেই আত্মহত্যার মূল কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। এ আলোচনায় ডুর্খেইম তুলনামূলক পদ্ধতির আশ্রয় নেন। ডুর্খেইম বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর আত্মহত্যার হারের সাথে গোষ্ঠীগত অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সম্পর্কের ভিত্তিতে আত্মহত্যার সামাজিক কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে আত্মহত্যার আনুমানিক হারের তারতম্য বিশ্লেষণ করে তিনি এ ধারণা তুলে ধরেন যে, আত্মহত্যার জন্য সামাজিক ঘটনাবলি দায়ী।
আরও পড়ুন: এমিল ডুর্খেইম সামাজিক ঘটনা তত্ত্ব আলোচনা কর
যখন কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে, তখন এরূপ মৃত্যুকে আত্মহত্যা বা আত্মহনন বলে। যখন কোন ব্যক্তি নিজেকে গুলি করে অথবা অন্য কোন উপায় অবলম্বন করে আত্মহনন করে, তখন এ প্রকার আত্মহত্যার উপায়কে প্রত্যক্ষ উপায় হিসেবে গণ্য করা যায়। যখন অনশন করার ফলে কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে, তখন একে পরোক্ষ উপায়ে আত্মহনন হয়েছে বলে গণ্য করা যেতে পারে। আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে ডুর্খেইম সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খণ্ডন করে বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা বিশেষ সামাজিক পরিবেশে গড়ে উঠে। আত্মহত্যা বংশগত কারণে ঘটে না, যদি তাই হতো তাহলে অধিক বয়স্ক লোকদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বেশি হবে কেন?
ডুর্খেইম মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক ও ভৌগোলিক কারণের ভিত্তি বিশ্লেষণ করে বলেন যে, আত্মহত্যার সাথে এসব বিষয়ের নির্দিষ্ট কোন মাত্রাগত সম্পর্ক নেই। তবে ব্যক্তির সাথে সমাজব্যবস্থার নৈকট্যের মাত্রার উপরে ঐ ব্যক্তির আত্মহত্যার প্রেষণা (Motivation) নির্ভরশীল। তিনি বলেন, ব্যক্তির অবস্থান যখন দু’টি বিপরীত মেরুতে হয়, তখন তার আত্মহত্যার প্রেষণা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ব্যক্তি যখন অতীব ঘনিষ্ঠভাবে কিংবা অত্যন্ত ক্ষীণভাবে সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হয় তখনই আত্মহত্যার প্রেষণা জাগে। এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যা তত্ত্ব ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে তিন ধরনের আত্মহত্যার বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
১. আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা (Egoistic suicide): ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যকার সংহতি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ব্যক্তি নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে তখন এ ধরনের আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা ঘটে। আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা ব্যক্তির সৃষ্টি।
২. পরার্থমূলক আত্মহত্যা (Altruistic suicide): কোন সামাজিক, আদর্শিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার দরুন ব্যক্তি যখন আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ হয় তখন তাকে পরার্থ আত্মহত্যা বলে।
৩. নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা (Anomic suicide): সমাজব্যবস্থা যখন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আচার আচরণকে সঠিক পথে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালন করতে ব্যর্থ হয় তখন মানুষ সমাজজীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্নভাবে এবং আদর্শবর্জিত বা নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ডুর্খেইম আত্মহত্যার বিষয়ে সমাজতাত্ত্বিক যে ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন তা থেকে সামাজিক অবক্ষয়ের সূচক এর দৃষ্টান্ত মেলে। তিনি এ আলোচনায় তুলনামূলক পদ্ধতির আশ্রয় নেন। তাঁর গবেষণায় বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে আত্মহত্যার আনুমানিক হারের তারতম্য বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, আত্মহত্যার জন্য সামাজিক ঘটনাবলি দায়ী।