আইন মান্য করার কারণ
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বা আইনকে মেনে আসছে। জনগণ রাষ্ট্রের আইন মান্য করে কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়।
হবস, বেন্থাম, হল্যান্ড, অস্টিন প্রমুখ দার্শনিকদের মতে, ‘আইন যেহেতু সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ, সেহেতু মানুষ শান্তির ভয়ে অথবা অরাজকতার আশঙ্কায় আইন মান্য করে থাকে।’ অর্থাৎ আইন মান্য করে শাস্তির ভয়ে।
হেনরি মেইন, স্যাভিনি, সিজউইক, মেইটল্যান্ড প্রমুখ ঐতিহাসিক মতবাদের সমর্থকদের মতে, স্বভাবগত কারণে মানুষ আইন মান্য করে। কেবল শাস্তির ভয়ে মানুষ আইন মান্য করে না। কারণ আইন হলো ন্যায়ের প্রতীক, যা জনগণ কর্তৃক সমর্থিত।
আরও দেখুন: আইন কত প্রকার ও কি কি? – বিস্তারিত আলোচনা
রুশো, গ্রিন প্রমুখ আদর্শবাদী দার্শনিকদের মতে, কতকগুলো সুস্পষ্ট যুক্তির কারণেই মানুষ আইন মেনে চলে। আইন ব্যক্তি স্বাধীনতাকে রক্ষা করে। গ্রিন বলেছেন, ‘শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি।’ এছাড়া দুগুই, ক্লাবে, লাঙ্কি প্রমুখের মতে, ‘মানুষ আইন মান্য করে; কারণ এটি সমাজজীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও কল্যাণ আনয়ন করে।’
দার্শনিকদের মতামত বিশ্লেষণের মাধ্যমে আইন মান্য করার যে সব কারণ পাওয়া যায়; সেগুলো নিচে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. শ্রদ্ধাবোধ
বহুকাল ধরে প্রচলিত নিয়ম-কানুনের প্রতি মানুষের একটা শ্রদ্ধাবোধ থাকে। এ শ্রদ্ধাবোধ থেকেই মানুষ আইন মেনে চলে। এছাড়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেও তাদের প্রণীত আইন জনগণ মেনে চলে।
২. নির্লিপ্ততা
ব্যক্তি নির্লিপ্ততার কারণে আইন মেনে চলে। রাষ্ট্রের বিশালতার তুলনায় ব্যক্তি নিজেকে ক্ষুদ্র ও অপ্রয়োজনীয় মনে করে। রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড নিয়ে সে খুব একটা ভাবে না। রাষ্ট্রকর্তৃক আরোপিত বিধি-নিষেধ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়।
৩. শাস্তির ভয়
মানুষ শাস্তির ভয়ে আইন মান্য করে। আইন মান্য করা বাধ্যতামূলক। কেননা আইনের পেছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন থাকে। আইন ভঙ্গকারীকে রাষ্ট্র শাস্তি প্রদান করে থাকে। তাই জনসাধারণ শাস্তি ভোগ করার ভয়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং আইন মান্য করে থাকে।
৪. সহানুভূতি
মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সহানুভূতি আইন মান্য করায় ভূমিকা রাখে। মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে। এই সহানুভূতি সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে প্রেরণা যোগায়। এজন্যই মানুষ আইন মান্য করে থাকে।
৫. উপযোগিতা
আইনের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। আইন মানুষের জীবনকে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও উন্নত করার সহায়ক। আইনের উপযোগিতার কথা উপলব্ধি করে মানুষ আইন মান্য করে থাকে। আইন মান্য করার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
৬. যৌক্তিকতা
মানুষ যৌক্তিক কারণে আইন মান্য করে থাকে। আইনের যৌক্তিকতার উপলব্ধি মানুষকে আইন মান্য করার অনুপ্রেরণা দেয়।
৭. নিরাপত্তা
আইন মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দান করে। আইন না থাকলে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি বিপন্ন হতো। তাই মানুষ নিজেদের জানমালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আইন মেনে চলে।
৮. ধর্ম
প্রাচীনকালে ধর্ম ও আইন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। মানুষ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ধর্মীয় আইন ভঙ্গ করলে পরকালে শাস্তি পেতে হয় এই ভয়ে মানুষ আইন মেনে চলে।
৯. ন্যায়বোধ
মানুষ নৈতিকতার কারণে আইন মেনে চলে। আইন সাধারণত নীতিবোধ সম্পন্ন হয়। আইন সমাজের প্রচলিত নৈতিকতার সমর্থনপুষ্ট হয়ে থাকে। তাইতো ন্যায়বোধ থেকে মানুষ আইন মেনে চলে।
আরও দেখুন: আইনের উৎস কয়টি ও কী কী? – বিস্তারিত আলোচনা
১০. অভ্যাসবশত
মানুষ অভ্যাসবশত আইন মেনে চলে। মানুষ দীর্ঘকাল ধরে আইন মেনে আসছে। প্রচলিত আইনের মধ্যে বড় রকমের অসঙ্গতি না থাকলে মানুষ তার বিরোধিতাও করে না।
১১. ভবিষ্যত প্রয়োজন
রাষ্ট্রের ভবিষ্যত ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ, সুশৃঙ্খল পরিবেশ গড়ার তাগিদ থেকে মানুষ আইন মেনে চলে। ভবিষ্যত প্রয়োজন মানুষকে বর্তমান আইন মান্য করতে অনুপ্রাণিত করে।
১২. ব্যক্তিত্ব বিকাশ
আইন মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করে থাকে। আইনের উপস্থিতির কারণে ব্যক্তি স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাই মানুষ ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ রক্ষার্থে আইন মেনে চলে।
১৩. অধিকার রক্ষা
মানুষের উন্নত ও নিরাপদ জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন কিছু অধিকার। নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মানুষের প্রয়োজনীয় অধিকার ভোগ করার জন্য আইনের সুরক্ষা প্রয়োজন। নিজেদের অধিকার সুরক্ষা ও ভোগে যাতে কোনোরূপ বাধা সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে মানুষ আইন মান্য করে।
১৪. বিবেকবোধ
মানুষ বিবেকবোধ সম্পন্ন জীব। বিবেকের তাড়নায় মানুষ আইন অমান্য করতে প্রবৃত্ত হয় না। মানুষ বুদ্ধি ও বিবেকের প্রেরণায় আইন মান্য করে।
১৫. শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা
আইন সামাজিক অরাজকতা দূর করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে থাকে। মানুষের সুস্থ, সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার জন্য শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ অপরিহার্য।
১৬. দেশপ্রেম
দেশপ্রেম মানুষকে আইন মান্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, দেশের কল্যাণ, গণতন্ত্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক চেষ্টা করে, যা আইনকে যথাযথ মান্য করার মাধ্যমেই সম্ভবপর হয়।
সুতরাং মানুষ বহুবিধ কারণে আইন মেনে চলে। সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ রাষ্ট্রীয় জীবন নিশ্চিত করার জন্য আইনের উপস্থিতি অপরিহার্য। আইন মানুষকে সভ্য, সুশৃঙ্খলা ও উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। তাই মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং আইনের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে।
আরও দেখুন: আইন কি | আইন কাকে বলে | আইনের সংজ্ঞা দাও
আইন মান্য করার সুবিধা
আইন মান্য করার মাধ্যমে মানুষ যে সকল সুবিধা ভোগ করতে পারে সেগুলো নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা
মানুষ যখন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং আইনকে মেনে চলে তখন সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. অধিকার সংরক্ষণ
আইন মানুষের অধিকার রক্ষা করে। আইন মান্য করার মাধ্যমে প্রত্যেকে প্রত্যেকের অধিকারের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল হয় এবং সকলের অধিকার রক্ষিত হয়।
৩. প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি
আইন মান্য করার মাধ্যমে যেমন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষিত হয়, অনুরূপভাবে মানুষ প্রত্যেকে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ লাভ করে। কেউ কারও বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
৪. পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা
আইন মান্য করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা
আইন মান্য করার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষিত হয়। ফলে প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারে।
৬. সামাজিক অনাচার ও অশান্তি দূর
আইনকে যদি যথাযথভাবে মান্য করা হয়, তাহলে সমাজে কোনো সন্ত্রাস, অনাচার ও অশান্তি থাকতে পারে না। মানুষ সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনকে সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল করে গড়ে তুলতে আইনের কোনো বিকল্প নেই।