সামাজিকীকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
পরিবারের পর শিশুর সামাজিকীকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এটি হলো সামাজিকীকরণের অন্যতম মাধ্যম। এখানে শিশু আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা লাভ শুরু করে এবং বৃহত্তর সমাজ, সংস্কৃতি ও পরিবেশের রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আদর্শ ও আচার-আচরণের সাথে পরিচয় ঘটে। সমাজ অনুমোদিত আচারব্যবহার এবং সমাজের নিষিদ্ধ কাজকর্ম সম্পর্কে সে অবহিত হয়, আইনশৃঙ্খলার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ জাগে এবং সে সহনশীল হয়। তাছাড়া শিক্ষকের উপদেশ, নির্দেশনা, আচারব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গি ইত্যাদি শিশুর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর্যুক্ত পরিবেশে শিশু তার ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশের সুযোগ পায় এবং সমাজের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে গড়ে উঠে।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলো কি কি? |
শিক্ষা সামাজিকীকরণের অন্যতম মাধ্যম হওয়ায় শিশুর সামাজিকীকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিকীকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতটা ভূমিকা রাখে নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:
১. সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
সামাজিকীকরণের পরিবর্তনশীল এ প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অন্যতম। পরিবারের পরই শিশুকে শিক্ষার সংস্পর্শে আসতে হয়। তাই শিশু তার ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশের সুযোগ পায়। স্নেহ- মমতাহীন শাসন আর অনুশাসনে পূর্ণ শিক্ষা পরিবেশে শিশুর সুপ্ত সম্ভাবনা বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন পরেবেশে খাপখাইয়ে এবং নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। ফলে তার মধ্যে উদ্যোগ নেয়ার প্রবৃত্তি, স্বাধীন চেতনা, । মনোভাব, সহযোগিতা, আত্মনির্ভরশীলতা, নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি এসে যায়। আইন- শৃঙ্খলার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ জাগে এবং সে সহনশীল হয়। এছাড়াও আদর্শ শিক্ষকের ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গি প্রভৃতি শিশুর আচরণের শিক্ষা দিয়ে থাকে। তাই বলা যায় সামাজিকীকরণের অন্যতম প্রক্রিয়া শিক্ষা।
২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সামাজীকীকরণকে সার্থক করে
সামাজিকীকরণ হলো একটি পদ্ধতি এবং এ পদ্ধতির মাধ্যমেই মানুষ সামাজিক জীবে পরিণত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যক্তি মানুষের সামাজিকীকরণ প্রণালিতে সমাজে প্রচলিত প্রথা, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, এমনকী সমগ্র সমাজের সঙ্গে সঙ্গতি সাধনের উপায় ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং এভাবেই ব্যক্তি সমাজ ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য সাধনে সক্ষম হয়ে থাকে। সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সমাজের সঙ্গে নবজাতকের আত্তীকরণ সংগঠিত হয়ে থাকে এবং এভাবেই সামাজিক জীবন হিসেবে মানবগোষ্ঠীকে পরিচিত ও সার্থক করে তোলে।
৩. শিক্ষা সামাজিকীকরণকে ব্যক্তি জীবনের বিকাশ ঘটায়
শিক্ষা সামাজিকীকরণকে ব্যক্তি জীবন বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষার দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তা করা। মানবশিশু জন্মমুহূর্তে মাত্র কতকগুলো প্রবণতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য যে কৌশল বা দক্ষতা দরকার তা মানব শিশুর থাকে না। শিক্ষা মানুষকে যেসব কৌশল আয়ত্ত করতে শেখায় তা ব্যক্তি জীবনের সুপ্ত বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
৪. প্রাক-শিল্প যুগে সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
প্রাক-শিল্পযুগে, শিক্ষার সুবিধা ভোগ করতো কতিপয় ব্যক্তিগণ। তাই সামাজিকীকরণে শিক্ষার ভূমিকা তখন ছিল সীমিত আকারে। প্রাক-শিল্প সমাজে সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে অন্যান্য মাধ্যমের ভূমিকা ছিল বেশি। সেই সময় জীবন ছিল সহজ-সরল। তাই পরিবার ও পাড়া প্রতিবেশীদের মাধ্যমে সমাজ ও সমাজের সদস্যদের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের স্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও ধারণা সহজেই লাভ করা সম্ভব হতো।
৫. আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সামাজিকীকরণ
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্পায়নের পরবর্তীকালে সামাজিকীকরণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে শিক্ষার ভূমিকা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। তেমনি আবার শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন রকম পৃথকীকরণের আবির্ভাব ঘটেছে। তাছাড়া সমাজ বিবর্তনের এ পর্যায়ে শিক্ষার বিভিন্ন রকম বিশেষীকরণ সম্পাদিত হচ্ছে। তাই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা ব্যক্তি জাগিয়ে তোলে।
বাংলাদেশে শিক্ষার স্তর কয়টি ও কী কী? |
৬. শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিকীকরণ
শিক্ষা সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গোষ্ঠীজীবনে প্রচলিত সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে ব্যক্তি মানুষকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষাই হলো সর্বাধিক কার্যকরী উপায়। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে এবং সঠিকভাবে সামাজিকীকরণ সম্পাদিত না হয় তবে শিশু অল্প বয়সে অবাধ্য হতে পারে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে সফল ও সার্থক করে তোলে সুপরিকল্পিত ও সুপরিচিত শিক্ষা ব্যবস্থা। সমাজের সকল সদস্যের সামাজিকীকরণ যদি সার্থকভাবে সম্পাদিত হয় তাহলে সমাজজীবন স্বচ্ছন্দ ও সুসংহত এবং শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সমাজজীবনে এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদিত হয় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে।
৭. সংযোগকারী শক্তি হিসেবে শিক্ষার গুরুত্ব
আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সংযোগকারী শক্তি হিসেবে শিক্ষার গুরুত্ব অত্যন্ত। সমাজস্থ ব্যক্তি বর্গের মধ্যে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি, আচার-আচারণ প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এ রকম সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। যাতে করে সমাজস্থ ব্যক্তি বর্গের মধ্যে সংযোগকারী শক্তি হিসেবে গড়ে উঠে। উপর্যুক্ত শিক্ষা ছাড়া ব্যক্তির সমাজজীবনে সংযোগ ঘটানো সম্ভব নয়। তাই উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারা মানুষের মধ্যে এক ধরনের সংযোগকারী শক্তির সৃষ্টি করে। এ শক্তির সাহায্যে সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা যায়।
৮. শিক্ষা ব্যবস্থায় স্তরবিন্যাসের প্রতিফলন
বাস্তবে সকল সমাজেই সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস ও শিল্পব্যবস্থার মধ্যে এক গভীর সম্পর্কের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত। সম্পত্তিবান শ্রেণির সন্তান-সন্ততির লেখাপড়ার ব্যবস্থা হয় সাধারণত সমাজের বিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের ছেলেমেয়েদের পক্ষে বিভিন্ন কারণে ঐ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা সম্ভব হয় না। যে কোন শ্রেণি বিন্যস্ত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য ভিন্ন ভিন্ন মানের বিদ্যালয়ে বর্তমানে দেখা যায়। এভাবে সকল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিফলন দেখা যায়।