সামাজিক নিয়ন্ত্রণ
সর্বকালে সর্বদেশে সমাজস্থ মানুষের স্বাভাবিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বা বিধি মেনে চলার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। কারণ পারস্পরিক সম্পর্কই যখন সামাজিক জীবনের ভিত্তি তখন কতকগুলো মৌলিক প্রশ্নে যদি সমাজস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে চিন্তাভাবনার সঙ্গতি না থাকে তাহলে কোন স্থায়ী সুন্দর সামাজিক জীবনের ভিত্তি গড়ে উঠা সম্ভব নয়। সমাজকে সুসংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলাবদ্ধভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে কতকগুলো রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ মানুষের কার্যকলাপকে চালনা করতে হয়। যখন ব্যক্তি বা সমষ্টির আচার-আচরণের উপর সমাজের এরূপ চাপ আরোপিত হয়, তখন তাকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলা হয়।
কিশোর অপরাধ কি | কিশোর অপরাধ কাকে বলে |
সাধারণ অর্থে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে বুঝায়, মানবজীবনের বিশেষ অনুসরণ নীতি, যে অনুসরণ নীতির দ্বারা সমাজস্থ মানুষের আচার-আচরণ পরিচালিত হয়। সেজন্য সমাজবিজ্ঞানিগণ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ্ হচ্ছে কতকগুলো মূল্যবোধ, সামাজিক রীতিনীতির সমষ্টি যার মাধ্যমে সামাজিক সংহতি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয় এবং যার মাধ্যমে ব্যক্তিকে সামাজিক শিক্ষা দেওয়া হয়। আবার অনেকে ব্যাপক অর্থে ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটিকে নির্দেশ বলে মনে করেন। কারণ সমাজজীবনে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালার নির্দেশ মেনে চলতে হয়। সমাজজীবনে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালায় যেন সমাজবাসী প্রচলিত নিয়মের অধীনে থাকে। এ অর্থে ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটি নির্দেশ হিসেবে বুঝানো হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গোষ্ঠীবদ্ধ লোকের পারস্পরিক সম্বন্ধ এবং প্রচলিত জীবনধারাগত আদর্শ বা মূল্যবোধ জড়িত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক শব্দ দ্বারা নিয়ন্ত্রণকে বিশেষিত করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ‘সামাজিক নিয়ন্ত্রণ’ পদবাচ্যটির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী জোসেফ এস. রফেক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, “কতকগুলো সমষ্টিগত শব্দ যার দ্বারা ব্যক্তি সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ সম্বন্ধে অবগত হয়ে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে।” উক্ত সংজ্ঞা অনুসারে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের যে ধারণা আমরা পাই তা থেকে বলা যায় যে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ্ হচ্ছে এমন কতকগুলো মূল্যবোধ, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান যা সামাজিক সংহতিকে দৃঢ় করার প্রয়াস পায়।
Metta Spencer এর মতে, “Social control is the process by which members of a group support desired forms of behaviour and discourage undesired forms.
ম্যাকাইভার ও পেজ তাঁদের ‘Society’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “By social control is meant the way in which the entire social order coheres and maintains itself how it operates as a whole, as a changing equilibrium.” অর্থাৎ, যে প্রণালিতে সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত থাকে ও আপনাকে সংরক্ষিত করে এবং একটা পরিবর্তনশীল ভারসাম্য বজায় রেখে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে পারে, তাকেই সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলে। অর্থাৎ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে একটা পথ যার দ্বারা সমাজের কাঠামো, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সকল কিছু পরিচালিত হয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সংহতিকে টিকিয়ে রাখা, যার দ্বারা সকল পদ্ধতি একটি নিয়মের মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে।
সমাজবিজ্ঞানী রস (Ross) সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে একটি বিশেষ ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সামাজিক গোষ্ঠীর ব্যবহারের সাথে ব্যক্তিকে পরিচালিত করে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী রস (Ross) এর সমসাময়িক উইলিয়াম গ্রাহাম সামনার সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ‘A study of the sociological importance of usages, manners, customs and morals’ গ্রন্থের উপভাগে উল্লেখ করেন যে, লোকাচার দ্বারা যেভাবে সমাজের লোক পরিচালিত হয়, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারাও সেভাবে সমাজ পরিচালিত হয়ে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী গ্রাহাম সামনারের এ ধারণা থেকে বলা যায় যে, তিনি লোকাচার বলতে বুঝিয়েছেন সামাজিক আচার- আচরণ, রীতিনীতি যা ধারাবাহিকভাবে সমাজকে সংগঠিত করবে এবং যা সমাজের সংহতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল থাকবে। বস্তুতপক্ষে, আমরা দেখতে পাই যে, সমাজ পরিবর্তনশীল হলেও এমন কতকগুলো স্থায়ী বা স্থিরীকৃত সামাজিক মূল্য আছে যা সুষ্ঠু, সুন্দর সামাজিক জীবনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এসব সামাজিক মূল্যবোধগুলো সমাজ বহির্ভূত কোন ধারণা নয় বরং সমাজ থেকেই উদ্ভূত; কারণ এ বিশিষ্ট মূল্যবোধগুলো মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বয়স্ক অপরাধ ও কিশোর অপরাধের মধ্যে পার্থক্য |
জি. গুরভিচ এবং ডব্লিউ. ই. ম্যুর (G. Gurvitch & W. E. Moore) সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সামাজিক জীবনের সামগ্রিক আচার-আচরণের বিধি ও তার মূল্যবোধের কথা উল্লেখ করেন। তাঁদের মতে, “সামাজিক নিয়ন্ত্রণ্ বলতে সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক জীবনধারণের আচার-আচরণ, সামাজিক প্রতীক, আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা, মূল্যমান, আদর্শ অথবা দ্বন্দ্ব পরিহার করতে শিখে।” অর্থাৎ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কতকগুলো পদ্ধতি, প্রক্রিয়া এবং রীতিনীতির মাধ্যমে সমষ্টিগত সামাজিক কল্যাণ লাভের পথকে সুগম করে।
কিন্তু গিলিন ও গিলিন (Gillin and Gillin) সামাজিক নিয়ন্ত্রণের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হলো, “এমন কতকগুলো সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা বুঝায় যা ব্যক্তির কার্যের এবং মনোভাবের সামঞ্জস্য বিধানের পক্ষে অত্যন্ত অপরিহার্য।”
অনুরূপভাবে সমাজবিজ্ঞানী ব্রিয়ারলি (Brearly) সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “সামাজিক নিয়ন্ত্রণ্ হলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অথবা কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট কতকগুলো পদ্ধতি ও সংস্থা যার মাধ্যমে ব্যক্তি শিক্ষিত হয় এবং যেগুলো অনুকরণে সে ব্রতী হয় অথবা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের ভিত্তি যে সামাজিক মূল্যমানগুলো, সেগুলো রক্ষা করার জন্য ব্যক্তিকে বাধ্যও করা হয়।”
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীদের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞাগুলো থেকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যে আলোচনা করা হলো তা থেকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা লাভ করতে পারি। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ্ কতকগুলো পদ্ধতি, প্রক্রিয়া, প্রস্তাবনা ও অনুসরণ নীতি যার মাধ্যমে সমাজস্থ মানুষের সমাজ স্বীকৃত আচরণ পদ্ধতিতে সামঞ্জস্য বজায় থাকে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সামাজিক জীবনে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তবে আনুষ্ঠানিক ও ঘরোয়াভাবে যে যৌথ নিয়ন্ত্রণ সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবিত করে, ‘সামাজিক নিয়ন্ত্রণ’ সে ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে অর্থবহ হয়ে উঠে।