কৃষিভিত্তিক সমাজ
অনেকের মতে, যাযাবর পশুপালকরা তৃণভূমিতে অবস্থান করে ক্রমান্বয়ে কৃষি পদ্ধতি আবিষ্কার করে। আবার অনেকে মনে করেন, মানবজীবনে পশুপালন সমাজের পূর্বেই কৃষি সমাজের ভিত গড়ে উঠেছিল। ধারণা করা হয় যে, প্রায় ছয় হাজার বছর পূর্বে লাঙলের আবিষ্কার হবার সাথে সাথে কৃষিভিত্তিক সমাজ এর আবির্ভাব ঘটেছিল। অবশ্য ভৌগোলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবন প্রাথমিক অবস্থায় প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতিনির্ভর ছিল। সেজন্য তার শ্রম প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ণীত হতো। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এমন কতকগুলো ধারণা পাওয়া যায়, যা থেকে সময়োপযোগী সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পশুচারণ ভূমি থেকে শাকসবজি এবং ফলমূল যোগাড় করা সহজ ছিল। সেজন্য অনেক পশুপালক সমাজ থেকে কৃষিকাজের সূচনা হয়। আবার অনেক পশুপালক সমাজ কৃষিকাজ করলেও কৃষি তাদের মুখ্য পেশা ছিল না; যেমন- উত্তর-পূর্ব ইউরোপের তুন্দ্রা অঞ্চল এবং আরবের মরুভূমি অঞ্চলের লোকদের একমাত্র পশুপালন করাই সম্ভব হতো।
পশুপালন সমাজ কাকে বলে ও বৈশিষ্ট্য |
কৃষিভিত্তিক সমাজে ভূমির গুরুত্ব বেড়ে যাবার ফলে ভূমির দখলকে কেন্দ্র করে তাদের মাঝে সংঘর্ষ বাঁধত। এ সংঘর্ষের ফলে পরাজিত পরিবারের সদস্যদের বন্দি করে রাখা হতো। এসব পরাজিত বন্দি দ্বারা তাদের যাবতীয় গৃহকার্য করাতো এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিভূমি তৈরি করাতো। ক্রমান্বয়ে এসব বন্দি তাদের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হলো। দীর্ঘকাল যাবৎ এরূপ অসমতা এবং শোষণ থেকেই সমাজে দাসপ্রথা রূপলাভ করে।
Beals and Hoijer তাঁদের ‘An Introduction to Anthropology’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “Two great agricultural areas may be distinguished. One is characterized by wheat as the dominant plant and extends from Europe, North Africa and the near east across central Asia. To North China associated with wheat in this area is a variety of other plants especially barley and rye with emphasis on cattle, sheep, horses, goats and pigs and except in China dairing. The second area is the great rice growing, region of Japan, South-China, South-East Asia, Indonesia and India.”” অর্থাৎ, কৃষিক্ষেত্রকে দু’টি বৃহৎ এলাকায় ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম এলাকাটি গমপ্রধান অঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত এবং এটি ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, নিকট প্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়া থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত। এ অঞ্চলটি গম দ্বারা বেষ্টিত হলেও অন্যান্য শস্য; যেমন- বার্লি, রাই ইত্যাদিও উৎপন্ন হয়। তাছাড়া এ এলাকায় গবাদি পশু; যেমন- ভেড়া, ঘোড়া, ছাগল ও শূকর এবং চীনের গরুর খামার ইত্যাদি বেশি দেখা যায়। আর দ্বিতীয় এলাকাটি হলো ধানপ্রধান অঞ্চল। এ এলাকা হচ্ছে জাপান, দক্ষিণ চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত।
কৃষিভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য
১. এ সমাজে স্থায়ী আবাসন গড়ে উঠে।
২. খাদ্যের নিশ্চয়তা লাভ করা যায়।
৩. খাদ্য উৎপাদনে পশুর ব্যবহার শুরু হয়।
৪. বিনিময় মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়।
৫. এ অধিবাসীদের জীবনধারা ছিল সহজ সরল।
৬. মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে।
৭. বিভিন্ন আবিষ্কার; যেমন- গোলাবারুদ, বাষ্পচালিত কল, শক্তিচালিত কল, মুদ্রণ যন্ত্র, ঘড়ি ইত্যাদি সাধিত হয়।
৮. সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
৯. ভাবের আদান-প্রদান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়।
১০. ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
১১. ব্যক্তিমালিকানা এবং সামাজিক স্তরবিন্যাস দেখা যায়।
১২. এ সমাজে অসমতা জটিল রূপ ধারণ করে।
১৩. কৃষিনির্ভর সমাজের শ্রমিকরা ছোটখাটো শিল্পে নিয়োজিত থাকতো।
১৪. এ সমাজে কর্মশালার সূত্রপাত ঘটে।
১৫. নগরের বিকাশ ঘটে।
১৬. কৃষিনির্ভর সমাজের অধিবাসীদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও গভীর সংহতিবোধ বিদ্যমান ছিল।
১৭. এ সমাজে একটি শহুরে শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে।
শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ ভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য |
বস্তুত সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতিতে কৃষির অবদান অপরিসীম। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থাতেই পরিবারের ভিত গড়ে উঠে এবং শিল্পকলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। এ সমাজেই যাযাবর জীবনের পরিপূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মানুষ সংঘবদ্ধ ও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।