নগর সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে?
সাধারণ অর্থে নগর সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে নগর সমাজের সামগ্রিক দিক নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক অনুশীলন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার একটি ক্ষুদ্রতম অংশ হচ্ছে নগর সমাজবিজ্ঞান। কেননা গ্রামীণ, শহুরে, শিল্পায়িত কি অশিল্পায়িত, পুঁজিবাদী কি সাম্রাজ্যবাদী যে কোন ধরনের সমাজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত।
নগর সমাজবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের ক্ষুদ্রতম ও নবীন শাখা হলেও এর বিস্তৃতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা এ বিজ্ঞান শুধুমাত্র নগর জীবনের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা এবং তার সমাধান, নগর সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ, স্থাপত্যকলা তথা সামগ্রিক নগর জীবন নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। তাই স্থান-কাল ও সমাজভেদে নগর সমাজের রূপ ও প্রকৃতি ভিন্নতর হয়ে থাকে। এ ভিন্ন ভিন্ন সমাজকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নগর সমাজবিজ্ঞান সদা তৎপর থাকে।
নগর সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
স্থান-কাল ও সময়ভেদে নগর সমাজ যেমন বিভিন্ন ধাঁচের হয় তেমনি সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও প্রকৃতিও বিভিন্ন ধাঁচের হয়ে থাকে। তাই সমাজবিজ্ঞানীগণ একে একটি সর্বজনীন সংজ্ঞার আওতায় আবদ্ধ করতে পারেন নি। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীগণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে নগর সমাজকে যেমন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন তেমনি ভিন্ন ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িতও করেছেন।
বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী নীল এন্ডারসন তাঁর “Urban Sociology” গ্রন্থে বলেন যে, গ্রামীণ ও নগর সমাজবিজ্ঞান নামে দু’টি পৃথক সম্প্রদায়গত বিজ্ঞান রয়েছে, যার একটি গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান, যেখানে গ্রামীণ সমাজের গঠনশৈলী ও সামগ্রিক কাঠামো নিয়ে আলোনা করে। সেই সাথে অন্যটি হচ্ছে নগর সমাজ বিজ্ঞান যা নগর তথা শহুরে জীবনের নৈতিক কাঠামো, নগর জীবনযাত্রার বৈচিত্র্যময় সকল দিককে পুঙ্খানুপঙ্খ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। এ জন্য অনেকেই নগর সমাজবিজ্ঞানকে শহর বা নগর জীবনের সামগ্রিক দিক নিয়ে আলোচনার স্বতন্ত্র বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেন।
উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আর. এন. শর্মা তাঁর, “Urban Sociology” গ্রন্থে বলেন যে, “Urban sociology is the study of urban society. The urban society is studied and investigated according to sociological methods and techniques. These techniques of course are scientific.” অর্থাৎ, নগর সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে নগর সমাজের বিজ্ঞানভিত্তিক অনুশীলন। নগর সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে গিয়ে সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতি ও কৌশলকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন: সামাজিক স্তরবিন্যাস কি? সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
নগর সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি
সমাজবিজ্ঞানের সামগ্রিক আলোচনাই মূলত জটিলতর সমাজকে ঘিরে। এ জটিলতর সমাজের দু’টি ভিন্ন রূপ হচ্ছে গ্রামীণ ও শহুরে সমাজ। সমাজবিজ্ঞানের যে শাখায় শুধুমাত্র শহুরে সমাজের যাবতীয় বিষয় আলোচিত হয় তা-ই নগর সমাজবিজ্ঞান।
নগর সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও স্বরূপ নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানীগণ বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে এল সিম্স বলেন, “The field of urban sociology is the study of association among people living by or immediately dependent upon industry and non agricultural activities.” অর্থাৎ, নগর সমাজবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে অকৃষিজ কর্মকাণ্ড এবং শিল্পনির্ভর কর্মকাণ্ডে জড়িত সকল মানুষের সামগ্রিক দিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের একমাত্র মাধ্যম। মোটকথা, নগর জীবনে বসবাসকারী মানুষের সাথে মানুষের যে প্রথাগত সম্পর্ক গড়ে উঠে তার যাবতীয় দিক আলোচনাই নগর সমাজবিজ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্য।
সমাজবিজ্ঞান পূর্ণাঙ্গ সমাজ ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে কিন্তু নগর সমাজবিজ্ঞান শুধুমাত্র নগর সমাজের ইতিবৃত্ত নিয়ে আবর্তিত। তাই নগর সমাজবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। নগর সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা থেকেই এর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। কেননা নগর তথা শহুরে জীবনের প্রকৃতি, সমস্যা, উন্নয়ন, অগ্রগতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হলে নগর সমাজবিজ্ঞানের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া নগর সমাজবিজ্ঞানের গঠনমূলক দিকনির্দেশনা নগর জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময়রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই নিচে নগর সমাজবিজ্ঞানের কতিপয় মৌলিক দিক উপস্থাপন করা হলো-
১) নগর সমাজবিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ
নগর সমাজবিজ্ঞানের সকল আলোচনা নগর সমাজকেন্দ্রিক। তািই নগর জীবনের এমন কোন দিক নেই যা নগর সমাজবিজ্ঞানের আলোচন্য বিষয়কে স্পর্শ করে না। গ্রামীণ সমাজ যেম শুধুমাত্র গ্রামকে নিয়ে, শিল্প সমাজবিজ্ঞানে যেমন শুধুমাত্র শিল্পনির্ভর সমাজকে ঘিরে আবর্তিত হয় তেমনি নগর সমাজবিজ্ঞানের সামগ্রিক আলোচনাও নগর সমাজকে ঘিরে আবর্তিত হয়।
২) নগর সমাজের গঠনশৈলী বিশ্লেষণ
কি কি উপাদান সমন্বিত হয়ে একটি সমাজ নগর সমাজে রূপ পরিগ্রহ করে তা নগর সমাজবিজ্ঞানে আলোচিত হয়। তাই নগর সমাজের গঠনশৈলীর সামগ্রিক দিক আলোচনা নগর সমাজবিজ্ঞানের একটি মৌলিক দিক হিসেবে বিবেচিত হয়।
৩) নগর সমাজবিজ্ঞান বিজ্ঞানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত
নগর সমাজের সামগ্রিক দিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সমাজবিজ্ঞানীগণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। কেননা যে কোন জ্ঞানকে সর্বজনীন ধারায় প্রতিষ্ঠা করতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে নগর সমাজবিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত একটি বিজ্ঞান।
৪) নগর সমাজবিজ্ঞানের আলোচনা নিরপেক্ষতা বজায় রাখে
নগর সমাজবিজ্ঞান নগর সমাজের ইতিবাচক, নেতিবাচক, ভালমন্দ, উচিত, অনুচিত ইত্যাদি বিষয়ে পক্ষপাতমূলক মনোভাব পোষণ না করে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। কেননা মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা যে কোন বিজ্ঞানের অন্যতম মৌল শর্ত। এ জন্য নৈতিকতার প্রশ্নে নগর সমাজ বিজ্ঞান সর্বদা নিরপেক্ষতা নজায় রেখে নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
৫) নগর সমাজবিজ্ঞান একটি বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞান
সমাজবিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা হিসেবে নগর সামজবিজ্ঞান একটি বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞান। কারণ নগর সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের রূপ লাভ করেছে। কোন তাত্ত্বিক কাঠামো ছাড়া সামাজিক সংগঠন ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর বিভিন্ন বিজ্ঞান হচ্ছে সমস্যার তাত্ত্বিক অধ্যয়ন। তাই নগর সমাজবিজ্ঞানকে কলা না বলে একে বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞান বলা হয়।
উল্লেখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নগর সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে নগর সমাজের অনুসন্ধানভিত্তিক অধ্যয়ন। কেননা নগর সমাজের বাস্তব চিত্র নগর সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় প্রতিফলিত হয়। নগর সমাজের যাবতীয় বিষয়াবলির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, নগর জীবনের সমস্যা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি সবই নগর সমাজবিজ্ঞানের স্বরূপ প্রকাশ করে।