1.6K
“সমাজবিজ্ঞান একটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান” – উক্তিটি করেছিলেন স্যামুয়েল কোনিগ।
আজকের আলোচনায় এই উক্তিটির যথার্থতা ব্যাখ্যা করব।
ব্যাখ্যা
আধুনিককালে সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় সমাজবিজ্ঞানেরও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সমাজবিজ্ঞান একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক বিজ্ঞান। অবশ্য অনেকেই একথা মানেন না। তাঁদের মতে, সমাজবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন ভিন্ন আর কিছুই নয়। এ কারণেই ‘সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান কি না’ তার বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
যে কোন বিজ্ঞানেরই নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ে প্রাধান্য থাকে; যেমন-
ক. সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে জ্ঞানের নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করে;
খ. সেটার গঠন কাঠামো বিশ্লেষণ করে;
গ. তার পদ্ধতি পর্যালোচন করে।
আমরা এখন উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ের আলোকে আলোচনা করে দেখব যে, সমাজবিজ্ঞান যথার্থই একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান কি না ।
সমাজবিজ্ঞান সমাজ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান দান করে। এ বিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয় অত্যন্ত বাস্তবধর্মী। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সমাজবিজ্ঞানী গিডিংস মনে করেন, অন্যান্য বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর আলোকে সুষ্ঠু যুক্তি প্রয়োগের পদ্ধতিতে প্রমাণ করে দেওয়া সম্ভব যে, সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান।
সমাজবিজ্ঞান সমাজের সামাজিক জ্ঞানের নির্ভরযোগ্যতা হিসেবে প্রমাণ করে দেয় যে, সমাজবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান এবং অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় এর একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে; যেমন- অর্থনীতি সমাজের আর্থিক দিক। যথা : ভোগ, বণ্টন, চাহিদা ও সরবরাহ সম্বন্ধে একটি নির্ভরযোগ্য জ্ঞান দান করে; তেমনি সমাজবিজ্ঞানও সমাজের জনসংখ্যা, অপরাধ তত্ত্ব, পরিবার ও সামাজিক সম্পর্ক উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে একটি নির্ভরযোগ্য জ্ঞান দান করে। তাছাড়াও সমাজের অনেক ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানিগণ সাধারণ নীতি ঘোষণা করে থাকেন।
আরও পড়ুন: সমাজবিজ্ঞানের পরিধি আলোচনা কর
অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের নির্ধারিত নীতি ভ্রান্ত হলেও সমাজবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দানে অস্বীকার করা চলে না। তাই সমাজবিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো একটি বিজ্ঞান। নিশ্চিত বিজ্ঞান না হলেও এটি অন্তত একটি সম্ভাব্য বিজ্ঞান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীদের সাধারণ নীতি সমাজে একটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে থাকে; যেমন- সমাজে বিবাহরীতি ও স্ত্রী-পুরুষের অবৈধ মিলনের নিয়ন্ত্রণ ।
সমাজবিজ্ঞান জ্ঞানের সুগঠিত পন্থা অবলম্বন করে। এটা পারস্পরিক জ্ঞানের নির্ভরশীলতার মাঝে কোন বিষয়ে সুসংবদ্ধ জ্ঞান অন্বেষণে সাহায্য করে; সেজন্য সমাজবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করা চলে। সমাজবিজ্ঞান সবসময়ই একটি নিরঙ্কুশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চায়। এ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে গিয়ে
সমাজবিজ্ঞান অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান হতে আলাদা ভূমিকা পালন করে; যেমন-
ক. সমাজবিজ্ঞান ব্যক্তি ও সমাজ সম্পর্কে উন্নত জীবন গঠনের পক্ষে সহায়ক।
খ. সমাজবিজ্ঞানীদের জ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধান করা যায়।
গ. সামাজিক সমস্যা ও সামাজিক উন্নতির পক্ষে সমাজবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
সমাজবিজ্ঞান প্রায়ই এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যা প্রধানত সামাজিক মূল্যবোধ ও সামাজিক নৈতিকতা বিজড়িত। অনুরূপ ক্ষেত্রে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান হতে সমাজবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্রধর্মী হিসেবে দেখা যায়।
সমাজবিজ্ঞান অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো মেনে চলে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীদের মতো সমাজকে অধ্যয়ন করার জন্য কোনরূপ গবেষণাগার নেই। কিন্তু তাই বলে সমাজকে এলোপাতাড়িভাবে জানতে চায় নি, বরং সমাজবিজ্ঞানিগণ সমাজকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করছেন। এ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান সামাজিক মানুষকে বৈজ্ঞানিক মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে ।
উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে, সমাজবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান এবং তা অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান হতে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বিরাজমান। সমাজবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে মেনে নেয়ার মাঝে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে; যেমন- সমাজবিজ্ঞান সমাজকে অধ্যয়ন করতে গিয়ে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করে।
সমাজবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে। কারণ সমাজবিজ্ঞান এর নিজস্ব নিয়মশৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে থাকে। কাজেই সমাজবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান এবং তাকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে মেনে নেয়ার পিছনে অযৌক্তিক কোন ধারণার অবকাশ থাকতে পারে না।
সমাজবিজ্ঞানীগণ যখন সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করবেন তখন কি তারা ভালোমন্দের বিচারবিবেচনা করবেন? এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে জাগতে পারে; যেমন- বাংলাদেশে যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে যাওয়া সম্পর্কে কি তারা নীতিগত কোন মতামত ব্যক্ত করবেন? অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান কি মূল্যমান নিরপেক্ষ হবে না মূল্যমান নির্দেশক হবে?
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে অগাস্ট কোঁতের দৃষ্টবাদ (Positivism), জীববিজ্ঞানের অভিব্যক্তিবাদ (Evolutionism) এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের অনুশীলন পদ্ধতি দ্বারা সমাজবিজ্ঞানিগণ প্রভাবিত হয়েছিলেন। তখন সমাজবিজ্ঞানের মূল্যায়নের ভূমিকা যাচাইয়ের ব্যাপারে তেমন কোন গুরুত্ব আরোপ করা হতো না বললেই চলে। কারণ সমাজবিজ্ঞানকে মূল্যমান নিরপেক্ষ শাস্ত্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টাই ছিল একমাত্র – উদ্দেশ্য।
সুতরাং সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সমাজের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা সঙ্গত বলেই তাদের ধারণা ছিল । তাদের মতে ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় ও বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিতের বিচার নীতিশাস্ত্রের বিষয়, – সমাজবিজ্ঞান তা নির্ধারণ করার প্রয়াস রাখে না। তাদের আশঙ্কা ছিল যে, এ ধরনের আলোচনায় লিপ্ত হলে সমাজবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হবে এবং সমাজবিজ্ঞান একটি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। অবশ্য এখনো সমাজবিজ্ঞানিগণ মোটামুটি এ মত পোষণ করেন।
আরও পড়ুন: সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা
কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীগণ আদর্শের দিক হতে তা মেনে চললেও আদর্শ রূপায়ণ করতে গিয়ে কতিপয় বাধার সম্মুখীন হয়েছেন; যেমন- আমরা যে সমাজে বসবাস করি তা হলো কিন্তু সমাজবিজ্ঞানিগণ আদর্শের দিক হতে তা মেনে চললেও আদর্শ রূপায়ণ করতে বিধিশাসিত সমাজ (Normative Society)। আমাদের কোনকিছু করা বা না করা তা প্রত্যক্ষভাবেই হোক বা পরোক্ষভাবেই হোক সমাজে প্রচলিত বিধিনিষেধের উপর নির্ভর করে। এ বিধিনিষেধগুলো আবার কয়েকটি মৌল মূল্যবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সমাজে বাস করে কারো পক্ষে এ মৌল মূল্যবোধগুলোকে উপেক্ষা করে চলা প্রায় অসম্ভব।
এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীদের যুক্তিগ্রাহ্য এবং বুদ্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত কোন বিচার যদি সমাজের মৌল মূল্যবোধের বিরোধী হয় তাহলে আত্মরক্ষার খাতিরে তাদের সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে। কারণ মানবিক বিষয়াবলিতে সমাজবিজ্ঞানকে যদি কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হয় তবে অবশ্যই মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করে অগ্রসর হতে হবে। কেননা মানবিক মনোভাব, মানুষের উদ্দেশ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য সর্বদাই সমাজবিজ্ঞানের সাথে জড়িত।
সমাজবিজ্ঞানিগণ যখন নানারকম সামাজিক সমস্যাবলি নিয়ে অনুসন্ধান কার্য চালান তখন দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে মূল্যমান নিরপেক্ষ হওয়া অসম্ভব; যেমন- অনেক সময় অনেক সমাজবিজ্ঞানী সামাজিক মূল্যবোধের বিরোধী কাজকর্মকে সমস্যা বলে মনে করেন এবং অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের সাহায্যে সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে সঙ্গতি রেখে সমস্যার প্রতিকারের উপায় নির্দেশ করেন।
তাছাড়া দেখা গেছে যে, সামাজিকীকরণের ফলে আমাদের জীবনে এমনভাবে সমাজের বিধিনিষেধের সংমিশ্রণ বা সঙ্গীকরণ ঘটে যার ফলে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধের দ্বারা আমাদের কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনা প্রভাবিত হয়। এক্ষেত্রেও শত চেষ্টা সত্ত্বেও সম্পূর্ণভাবে মূল্যমান নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।
তবে এটিও অনস্বীকার্য যে, সমাজবিজ্ঞানিগণকে যথাসম্ভব ভালোমন্দ বিচার পরিহার করে চলতে হবে এবং এদিকে লক্ষ্য রাখলে বিচার বিশ্লেষণ পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হবে না। কারণ সমাজবিজ্ঞানিগণ উদ্দেশ্যমূলকতা নিয়ে যতই নিরপেক্ষ হতে চেষ্টা করুন না কেন, সমাজে ক্রিয়াশীল ভাবধারা মানবমনে প্রভাব বিস্তার করবেই করবে। এটা খুবই স্বাভাবিক। অতএব, পদার্থবিজ্ঞানী ও রাসায়নিকের মতো মূল্যমান নিরপেক্ষ হওয়া সমাজবিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব নয়, যদিও সমাজবিজ্ঞানিগণ মূল্যমান নিরপেক্ষতা রক্ষা করার চেষ্ট করেন।