অনলাইন ব্যাংকিং এর সুবিধা
প্রচলিত ব্যাংকিং-এর তুলনায় অনলাইন ব্যাংকিং গ্রাহক পর্যায়ে লেনদেন, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, ব্যয় কমানো, দ্রুত সেবা প্রদান ইত্যাদি নানা বিষয়ে কিছু বাড়তি সুবিধা প্রদান করে। এ সুবিধা যেমন গ্রাহক পর্যায়ে পাওয়া যায়, তেমনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষও অনলাইন ব্যাংকিং এর নানা সুবিধা ভোগ করে থাকে। অনলাইন ব্যাংকিং এর সুবিধা সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. অনলাইন ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে ব্যাংকিং-এর সর্বোত্তম সেবা জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো সম্ভবপর হয়। এর ফলে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয় পর্যায়ে ব্যাংকিং বাবদ ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে কম হয়। তবে এজন্য গ্রাহকদের ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থাকতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকের সব শাখায় অনলাইন ব্যাংকিং এর সুবিধা থাকতে হবে। না হলে ব্যাংকের যে শাখায় অনলাইন ব্যাংকিং-এর ব্যবস্থা আছে, সেখানেই শুধু এ সুবিধা পাওয়া যাবে।
২. অনলাইন ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে কাগজের ব্যবহার কমানো, ডাক খরচ কমানো, সময় সাশ্রয় করা সম্ভব হয়। ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় হিসাব বিবরণী, ব্যালান্স কনফারমেশন, পেমেন্ট অর্ডার ইত্যাদি কাজে ভৌত উপকরণাদি যেমন কাগজ, কলম ইত্যাদি কম লাগে এবং একাধিক পর্যারে হিসাব-নিকাশ করার বদলে একটি ধাপেই কম্পিউটারের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব-নিকাশ করা যায়। ফলে সব মিলিয়ে ব্যাংকিং সেবা দ্রুতগতি ও নির্ভরযোগ্য হয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংক কাকে বলে | বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলী আলোচনা কর |
৩. অনলাইন ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে নানা জিনিস সহজে বাজারজাতকরণ করা যায়। বিশেষত ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড, কলসেন্টার স্থাপন, কিংবা পিওএস সিস্টেমের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের কারণে দ্রব্য বাজারজাতকরণে নতুন গতির সৃষ্টি হয়েছে। আগের চেয়ে মূল্য পরিশোধ দ্রুতগতিতে করা যাচ্ছে। ফলে দ্রব্য বিনিময়ের কাজটি অনেক সহজতর হয়েছে। অনলাইন ব্যাংকিং-এর কারণে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও কেনাকাটা ও লেনদেন করা সম্ভবপর হয়ে থাকে।
৪. অনলাইন ব্যাংকিং-এর কারণে অনেক ভুলভ্রান্তি এড়ানো সম্ভবপর হয়। অনলাইন ব্যাংকিং কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বলে পুরানো পদ্ধতির মতো লেনদেনের প্রতিটি হিসাব কাগজে তুলে রাখার প্রয়োজন হয় না। এতে করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই গ্রাহকদের সেবা দেওয়া সম্ভব। তেমনি বিভিন্ন জায়গায় হিসাব তোলা ও মেলানোর সাথে সম্পর্কিত ভুলভ্রান্তিও এড়ানো সম্ভব।
৫. অনলাইন ব্যাংকিং-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এটি পরিবেশবান্ধব। প্রচলিত ব্যাংকিং-এ বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ রাখার জন্য প্রচুর সম্পদ, বিশেষত ছাপানো উপাদানের প্রয়োজন হয়। ব্যাংক ও গ্রাহক উভয় পর্যায়ে চেক বই বা হিসাব-নিকাশ খাতা থেকে প্রচুর দস্তাবেজ বা ডকুমেন্টস থাকে। আর এসবের জন্য প্রচুর পরিমাণ কাগজ প্রয়োজন হয়। এ কাগজ মূলত কাঠ থেকে উৎপন্ন হয়। অনলাইন ব্যাংকিং-এর ফলে কাগজ ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। ফলে তা পরিবেশের জন্য সহায়ক হয়। যে কারণে অনলাইন ব্যাংকিং আসার পর গ্রিন ব্যাংকিং বা সবুজ ব্যাংকিং নামে একটি নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২৭, ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে বিআরপিডি সার্কুলার নং ০২-এর মাধ্যমে সবুজ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এ নীতিমালা অনুসারে দেশের ব্যাংকসমূহ ২০১৩ সালের মধ্যে সবুজ ব্যাংকিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে।
৬. শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নানা প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে এ সুবিধা বর্তমানে সীমিত আকারে রয়েছে।
৭. চেক জালিয়াতি, নকল চেক কিংবা এ সম্পর্কিত প্রতারণা অনলাইন ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে এড়ানো যায়। ফলে চেক সম্পর্কিত বিড়ম্বনা এড়াতে অনলাইন ব্যাংকিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৮. দেশের বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে সরাসরি টাকা বহন না করে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করা যায়। এটি অনলাইন ব্যাংকিং-এর সুফল। এর ফলে মুদ্রা টাকা থেকে ডলারে রূপান্তরিত করা কিংবা ডলার থেকে টাকা ভাঙানোর বিষয় বাদ দিয়ে সরাসরি লেনদেন করা যায়। ফলে এতে সময়ের সাশ্রয় হয়।
৯. অনলাইন ব্যাংকিং-এর একটি অন্যতম উপাদান হলো এটিএম বুথ। সারাদেশে এখন প্রচুর পরিমাণে এটিএম বুথ রয়েছে। এসব বুথ থেকে যেকোনো সময় টাকা উত্তোলন করা যায়। ফলে গ্রাহককে এখন আর ব্যাংকিং-এর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। এছাড়া শুধু টাকা উত্তোলনই নয়। অনেক বুথে টাকা জমা দেওয়ার সুযোগও রয়েছে।
১০. বিভিন্ন ধরনের বিল যেমন গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল কিংবা মোবাইল ফোন বিল ইত্যাদি এখন সহজেই অনলাইন ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিশোধ করা যায়। ফলে এসব বিল পরিশোধের জন্য গ্রাহকদের এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না।
১১. অনলাইন ব্যাংকিং-এ গ্রাহক নিজেই তার প্রতিটি লেনদেনের হিসাব দেখতে পারেন। এজন্য গ্রাহককে ইন্টারনেটে তার অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিলেই অতীতের লেনদেনের রেকর্ড গ্রাহকের সামনে চলে আসবে। ফলে গ্রাহক নিজে যেমন তার লেনদেনের হিসাব রাখতে পারেন, তেমনি কোথাও কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তা সহজেই ধরতে পারেন।
১২. শুধু কম্পিউটার নয়, গ্রাহক তার মোবাইল ফোন ব্যবহার করেও অনলাইন ব্যাংকিং-এর লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন।
অনলাইন ব্যাংকিং এর অসুবিধা
অনলাইন ব্যাংকিং-এর প্রচুর সুবিধা রয়েছে। কিন্তু এর অসুবিধাও কম নয়। অনেক অসুবিধা রয়েছে যা প্রযুক্তিগত কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু অসুবিধা গ্রাহক বা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কারণেও সৃষ্টি হতে পারে।
অনলাইন ব্যাংকিং এর অসুবিধা সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. অনলাইন ব্যাংকের প্রধান অসুবিধা হলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে পুরোটাই কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা হ্যাকিং করে যাতে গ্রাহকদের অর্থ হ্যাকাররা না নিয়ে যেতে পারে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। যদিও এ ধরনের অসুবিধার কথা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। কিন্তু বিদেশে এ ধরনের অনেক উদাহরণ দেখা গেছে। গ্রাহক ও ব্যাংক উভয় পর্যায়ে সচেতন না থাকলে অনলাইনের ব্যাংকিং-এর যাবতীয় সুবিধা এ সমস্যার কারণে অসুবিধায় রূপান্তরিত হতে পারে।
২. অনলাইন ব্যাংকিং পদ্ধতি সুবিধাজনক হলেও একই ব্যাংকের সব শাখা কিংবা সব ব্যাংকে এ পদ্ধতি চালু না থাকলে অনেক সময় তা গ্রাহকের জন্য বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক দ্রুতগতির সেবা দেয়, কোনো ব্যাংকের শাখা প্রচলিত পদ্ধতিতে ধীরগতির সেবা দেয়। ফলে এটি লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৩. অনলাইন ব্যাংকিং দ্রুতগতিতে ও কম খরচে সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকসমূহ অনলাইন লেনদেনের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চহারে চার্জ নিয়ে থাকে। ব্যাংকভেদে এ ধরনের ফি কমবেশি হয়ে থাকে।
৪. অনেক গ্রাহকের জন্য লেনদেনের পর রসিদ কিংবা লেনদেনের কাগজ প্রয়োজন হতে পারে। অনলাইন ব্যাংকে অনেক সময় লেনদেনের কাগজ প্রিন্ট করার সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে গ্রাহকরা কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর |
৫. অনলাইন ব্যাংকিং-এ কাজ করার জন্য গ্রাহকদের একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হয়। এদেশের অধিকাংশ গ্রাহকই এ সম্পর্কে অবগত নন। তাই তারা শুরুতে এ বিষয়ে ভালোভাবে অবগত না হয়ে অনলাইনে লেনদেন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে পারেন।
৬. অনলাইনে জরুরি প্রয়োজনে লেনদেন করার সময় যদি কোনো কারণে ব্যাংকের সার্ভার বন্ধ থাকে। তাহলে গ্রাহক ওই সময় কোনো ধরনের লেনদেন করতে পারবে না। বিশেষ করে এটিএম বুথে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়।
৭. অনলাইন ব্যাংকিং সম্পর্কে গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের প্রযুক্তিগত ভীতি রয়েছে। ফলে যেভাবে এ ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিকশিত হওয়ার আশা করা হচ্ছিল, তেমনটি হয়নি। প্রযুক্তিগত ভীতির এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে অনলাইন ব্যাংকিং আরও দ্রুত বিকশিত হতে পারে।