ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য সমূহ
মানবজাতির অতীত কর্মের খতিয়ান হল ইতিহাস। এটি মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের প্রতিচ্ছবি ও নির্ভরযোগ্য দলিল। এজন্য ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাহমান স্রোতস্বিনীর ন্যায় এটি কালের নীরব সাক্ষী হিসেবে মানবীয় কর্মকাণ্ডের ধারক ও বাহকরূপে এগিয়ে চলছে। প্রতিটি ব্যক্তি, বস্তু, বিষয়, প্রাণী, সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রের যেমন কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে, তেমনি ইতিহাসেরও অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আছে। যে সকল বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ইতিহাস আমাদের নিকট গৌরবময় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :
১. উৎস ও তথ্যভিত্তিক
অন্যতম প্রধান ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য হলো উৎস ও তথ্যভিত্তিক। বস্তুত উৎস ছাড়া ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর যেকোন যুগের, যেকোন স্থানের বা যেকোন বিষয়ের ইতিহাস রচনা করতে অবশ্যই ঐতিহাসিককে উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়। যেমন- রোজেটা পাথর, হায়ারোগ্লিফিক লিপি প্রভৃতি প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার উৎস। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, রোজেটা পাথর ও হায়রোগ্লিফিক লিপি ব্যতীত প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা সম্পর্কে ভালভাবে জানা সম্ভব নয়। তেমনি পাকিস্তানের সিন্ধুনদের তীরে উৎখনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ সিন্ধু সভ্যতার উৎস। একইভাবে বলা যায়, রোটাসগড় গিরিগাত্র শশাঙ্কের ইতিহাসের উৎস, খালিমপুর তাম্রশাসন পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল সম্পর্কে জানার উৎস, রামচরিতম বরেন্দ্রবিদ্রোহ ও রামপালের ইতিহাসের উৎস। উৎস ও তথ্য ছাড়া ইতিহাস স্রোতহীন নদীর মত বন্ধ্যা ও অচল। ইতিহাস প্রামাণ্য উৎস ও তথ্যের মাধ্যমে স্বীয় কলেবরকে স্ফীত করে। সুতরাং প্রামাণ্য উৎস ও সঠিক তথ্য যথাযথ ইতিহাস রচনার জন্য অপরিহার্য।
২. অনুসন্ধানমূলক
অনুসন্ধিৎসুতা ইতিহাসের অপর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যে ‘Historia’ শব্দ হতে History শব্দের উৎপত্তি তার (Historia ) অর্থও সত্য প্রকাশ করার জন্য পরিকল্পিত অনুসন্ধান (An inquiry, designed to elicit truth)। ইতিহাস মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত কর্মের ওপর অনুসন্ধান পরিচালনা করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে। বিগত মানবসমাজ কী করেছে, কেন করেছে, কোন কাজটি করার ফলে কী ঘটেছে প্রভৃতি বিষয়ের ওপর অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে ইতিহাস। এটি যথাযথ পদ্ধতিতে অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে ভুল তথ্য পরিহার করে এবং সঠিক তথ্য গ্রহণ করে। ইতিহাসের অনুসন্ধানমূলক বৈশিষ্ট্য থাকার কারণেই হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়। এটি অনুসন্ধানমূলক কর্মের দ্বারা বিগত সমাজ ও সভ্যতার চিত্র বর্তমান সমাজের কাছে তুলে ধরে।
আরও পড়ুন: ইতিহাস শব্দের উৎপত্তি এবং ইতিহাসের সংজ্ঞা দাও
৩. আত্মোপলব্ধিমূলক
নিজেকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ ইতিহাসের পাতা থেকেই আমরা আমাদের জাতীয় তথ্যাবলি অবগত হতে পারি। অতীতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজ সংস্কারক, জাতীয় বীর, শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিদ্রোহ প্রভৃতি নানাবিধ তাৎপর্যপূর্ণ দিক সম্পর্কে আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি এবং ইতিহাস এ সব বিষয়ে আমাদেরকে আত্মোপলব্ধিতে অনুপ্রাণিত করে থাকে। ইতিহাস অতীতের গৌরবদীপ্ত প্রপঞ্চকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে তাদেরকে নব চেতনায় উদ্দীপিত করে। বস্তুত অতীত কর্ম পর্যালোচনা ব্যতীত আত্মোপলব্ধি সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, অতীত কর্ম পর্যালোচনা বলতে আমরা ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করাকে বুঝে থাকি। সুতরাং বলা যায়, ইতিহাস অতীত কর্মের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে মানুষকে আত্মোপলব্ধিতে অনুপ্রাণিত করে।
৪. সর্বজনীনতা
সর্বজনীনতা ইতিহাসের অপর একটি বড় বৈশিষ্ট্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এটি সমভাবে সকলের কর্মের খতিয়ান। নিকটবর্তী, মধ্যবর্তী ও দূরবর্তী প্রভৃতি সকল জাতির উত্থান-পতনের দিকে ইতিহাস সর্বজনীনভাবে অনুসন্ধিৎসু হয়। যেকোন বর্ণ ও গোত্রের লোক ইতিহাস রচনা করুক না কেন, তাকে অবশ্যই সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য ইতিহাস রচনা করতে হবে। ইতিহাসে বর্ণ বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, অঞ্চল বা অবস্থানগত কোন বৈষম্য থাকা একেবারেই সমীচীন নয়। ইতিহাসকে জাতিগত বা ধর্মগত ভ্রান্ত চেতনায় তাড়িত হয়ে বিকৃতরূপে চিত্রিত করা অনুচিত। কোন ইতিহাসই কোন জাতি, কোন গোষ্ঠী বা কোন একটি এলাকার জন্য রচিত হয় না। সকল ইতিহাসকে সকল যুগের সকল দেশ ও সকল জাতির জন্য রচনা করতে হবে। অন্যথায় এটি সর্বজনীন হবে না। সর্বজনীন ইতিহাস সব সময় সকল দেশ ও জাতির কাছে সমভাবে সমাদৃত হয় ।
৫. অতীতকে তুলে ধরা
ইতিহাস মানবজাতির অতীতের দর্পণ স্বরূপ। দর্পণের দিকে তাকালে যেমন স্বীয় প্রতিবিম্ব স্পষ্টভাবে অবলোকন করা যায়, ঠিক তেমনি ইতিহাসের দিকে তাকালে মানবজাতির অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমরা জানতে পারি, বুঝতে পারি ও উপলব্ধি করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস জীবন্ত অতীত হিসেবে অতীতের যাবতীয় কার্যক্রম ও ঘটনা আমাদের কাছে তুলে ধরে। সুতরাং বলা যায়, অতীতকে প্রমাণিত তথ্য হিসেবে তুলে ধরা ইতিহাসের মূল বৈশিষ্ট্য ।
৬. নিরপেক্ষতা
নিরপেক্ষতা অন্যতম একটি অত্যুৎকৃষ্ট ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য । সাদা, কালো, অনিষ্টকারী, কল্যাণকারী, স্বৈরাচারী, গণতান্ত্রিক, উৎপীড়ক, প্রজারঞ্জক প্রভৃতি সকল প্রকার ব্যক্তি ও রাজনৈতিক প্রশাসকের প্রতি এটি নিরপেক্ষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এটি স্বৈরাচারী, উৎপীড়ক ও নেতিবাচক শাসকদের দিক থেকে স্বীয় দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় না। আবার সুন্দর, গণতান্ত্রিক, ভাল ও প্রজারঞ্জক শাসক ও ব্যক্তির কথা অধিক গুরুত্বের সাথে ধারণ করে না। ইতিহাস সকল প্রকার শাসক ও ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে। সুতরাং নিরপেক্ষতা ইতিহাসের স্বরূপের একটি বিশেষ দিক।
৭. ধারাবাহিকতা
অনেক বৈশিষ্ট্যের মত ধারাবাহিকতা ইতিহাসের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস অবশ্যই এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে। ইতিহাসে বর্ণিত যেকোন ব্যক্তি, জাতি বা দেশের বর্ণনা অবশ্যই ধারাবাহিক হতে হবে। অর্থাৎ জন্ম বা সূচনা, ক্রমবিকাশ, চরমোৎকর্ষ ও পতনের বিবরণ ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে ধারণ করে থাকে।
৮. সময়ানুক্রমিকতা
ধারাবাহিকতার ন্যায় সময়ানুক্রমিকতাও ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কারণ ইতিহাসের পাতায় যত ঘটনা ও কর্মকাণ্ড স্থান লাভ করেছে সেগুলো নিশ্চিতভাবেই কোন না কোন সন-তারিখে সম্পন্ন ও সংঘটিত হয়েছে। কাজেই সম্পন্নকৃত বা সংঘটিত ঘটনাগুলো সময়ানুক্রমিকভাবে ইতিহাসের সুতোয় গ্রথিত হয়। সুতরাং সময়ানুক্রমিকতা অক্ষুণ্ণ রাখা ইতিহাসের বিশেষ ধর্ম ।
৯. মানবীয়তা
ইতিহাস মানুষের অতীত কার্যাবলির ওপর উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে। এটি মানুষের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। অর্থাৎ ইতিহাসের বিষয়বস্তু অবশ্যই মানবীয়, কোন অবস্থাতেই তা দানবীয় বা অতি মানবীয় নয়। অতএব বলা যায়, মানবকর্মের খতিয়ান ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল মানবীয়তা।
১০. প্রাচীনত্ব
কালের আবর্তে ইতিহাস ক্রমবিবর্তিত হয় এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে নতুনকে গ্রহণ করে পরিব্যাপ্ত হয়। তাই বলে এটি প্রাচীনকে অনাবশ্যকভাবে ত্যাগ করতে পারে না। কারণ প্রাচীনত্বই ইতিহাসের অন্তঃস্থল। প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর বিষয়গুলো ইতিহাসেরই উপাদেয় বিষয়। সুতরাং বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে ইতিহাস প্রাচীনত্বাশ্রয়ী ।
১১. সঠিকত্ব
ইতিহাস সঠিক ও প্রামাণিক তথ্য গ্রহণ করে থাকে। আজ যে বিষয়টি ইতিহাসে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত, আগামীতে নতুন এবং অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য তথ্য আবিষ্কৃত হলে ইতিহাস আজকের স্বীকৃত তথ্যকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন এবং এমনকি বর্জন করে নতুন ও সঠিক তথ্যকে গ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর হয়। কাজেই দেখা যায়, সঠিকত্ব ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যের একটি বিশেষ দিক।
১২. অবিচ্ছিন্নতা
ইতিহাস এক ও অবিচ্ছিন্ন। সতত প্রবাহমান ফল্গুধারার মত ইতিহাসের ঘটনাস্রোতও নিরন্তর প্রবাহমান। ফলে ইতিহাসকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ হিসেবে বিভক্ত করলে এটি কৃত্রিম হতে বাধ্য। তবে ইতিহাস অনুশীলনরত অগণিত ছাত্রছাত্রী ও পাঠকের সুবিধার কথা বিবেচনা করে একে উপর্যুক্ত তিনটি যুগে বিভক্ত করা হয়েছে। ইতিহাস অবিচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক হওয়া সত্ত্বেও কোন বিখ্যাত ঘটনা হতে এর অধ্যয়ন শুরু করতে হয়। ইতিহাস অনুশীলনরত সংশ্লিষ্ট সকলের সুবিধার জন্য এরূপ অধ্যয়ন অপরিহার্য। সুতরাং অবিচ্ছিন্নতা ইতিহাসের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য ।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা কর
১৩. যোগসূত্র স্থাপন
ইতিহাসের বর্তমান ভিত বা শিকড় সুদূর অতীতের অতি গভীরে গ্রোথিত। এটি আমাদের পূর্ব পুরুষদের কার্যাবলির খতিয়ান এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অতীতের সকল সম্পদ ও ধনভাণ্ডারের বিবরণ আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। অনুরূপভাবে এটি আমাদের কার্যাবলি ও ঘটনাপঞ্জিকে অমূল্য সম্পদ হিসেবে আমাদের ভাবী বংশধরদের জন্য সযত্নে সংরক্ষণ করে। অর্থাৎ ইতিহাস প্রাচীন যুগের ঘটনা মধ্যযুগের মানুষের কাছে এবং মধ্যযুগের ঘটনা আধুনিক যুগের মানুষের কাছে তুলে ধরতে সদা সচেষ্ট। এভাবে ইতিহাস সকল যুগের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে সেতুবন্ধনকারী এক সমুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যে পরিবৃত্ত হয়ে আছে।
১৪. পরিবর্তনশীলতা
ইতিহাস ব্যক্তিত্বের প্রতি আগ্রহশীল। কিন্তু সে আগ্রহ নিছক ব্যক্তিত্বে নয়; উপরন্তু মানব জীবনের বিবর্তন, ক্রমোন্নতি ও বৃহৎ আন্দোলনের ক্ষেত্রে যখন কোন ব্যক্তি অবদান রাখে, ইতিহাস ঠিক তখনই তার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়। যেহেতু পরিবর্তনকারী ও পরিবর্তিত ঘটনার প্রতি ইতিহাস আগ্রহী ও মনোযোগী হয় কাজেই বলা যায় পরিবর্তনশীলতা ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য। ঘটনার অন্তরালে যে ঘটনা ও রহস্য থাকে তা উদ্ঘাটন করতে পারলে এবং যথাযথ প্রামাণিক তথ্য পাওয়া গেলে ইতিহাস অনেক সময় অনেক পরিবর্তিত হয়। ইতিহাসের এ পরিবর্তন সঠিক ঘটনাকে তুলে ধরার জন্যই, ইতিহাসকে বিকৃতরূপে চিত্রিত করার জন্য নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে উৎখনন করে সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত ঐতিহাসিকদের ধারণা ছিল যে ভারতীয় সভ্যতা বৈদিক যুগ হতে শুরু হয়েছে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর ভারতীয় সভ্যতায় নবমাত্রা সংযোজিত হয় এবং প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে পরিবর্তন সূচিত হয়। ইতিহাস আর্য সভ্যতাকে ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা না বলে সিন্ধু সভ্যতাকে ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা বলে স্বীকৃতি দেয়।
১৫. নিজস্ব গতিতে চলা
সূচনাকাল হতে ইতিহাস অবিচ্ছিন্নভাবে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলছে। ইতিহাসের গতিপথ রোধ করা বা ইতিহাসকে স্বীয় গতিপথ হতে অন্যপথে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এটি নিজস্ব গতিতে চলে বলেই এতে ধনী-নির্ধন, সাদা-কালো, আশরাফ-আতরাফ, সকল ব্যক্তি ও জাতির কথা বর্ণিত হয়। ছোট-বড়
১৬. কলেবর বৃদ্ধি করা
কালের আবর্তন ও ঘটনার বিবর্তনের সাথে সাথে ইতিহাসের কলেবর বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের কর্ম ও ঘটনার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে ইতিহাসের পরিধি। সুতরাং স্বীয় কলেবর বৃদ্ধি করে ক্রমঅগ্রসর হওয়া ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য।
১৭. দেশপ্রেম জাগ্রত করা
ইতিহাসের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করা বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এটি মানুষকে স্বীয় জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন প্রভৃতি সম্পর্কে অবহিত করে। এটি নিজ দেশের বীরত্বগাথা ও গৌরবময় কার্যাবলির পাশাপাশি শোষণ ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করে তোলে ।
১৮. সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়া
বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক ইতিহাস সব সময় সচেতন জাতিকে সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়। যথাযথভাবে এটি অধ্যয়ন করলে মানুষের মধ্যে ভাবাবেগ বিবর্জিত সঠিক উপলব্ধির উন্মেষ ঘটে। আর সঠিক উপলব্ধি একটি জাতিকে একান্ত হিতসাধনমূলক সোপানের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সুতরাং বলা যায়, সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়া ইতিহাসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ।
১৯. মহানুভবতায় উদ্বুদ্ধকরণ
ইতিহাস মানুষকে পৃথিবীর সুমহান ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ ও কর্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক বংশগত মর্যাদা ও কৌলিন্য প্রথার বিনাশ সাধন, দাসপ্রথার উচ্ছেদ, সাম্য ও শান্তির বাণী প্রচার। ভারতের প্রাচীন যুগের মৌর্য সম্রাট রাজর্ষী অশোকের প্রজাপালনের দৃষ্টান্ত, বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতমবুদ্ধের অনাসক্ততা ও মহানুভবতা, মুঘল সম্রাট আকবরের অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি উদারতা প্রভৃতির সাথে ইতিহাসই প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এ বিষয়গুলো মানুষকে পরম সহিষ্ণু, উদার ও মহানুভব করে তোলে। অতএব দেখা যায়, মানুষকে মহানুভবতায় উদ্বুদ্ধকরণ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ।
২০. আন্তর্জাতিকতাবাদে দীক্ষাদান
পৃথিবীর যাবতীয় চুক্তি, এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের নানাবিধ সম্পর্ক, সকল প্রকার শাস্তি সম্মেলন, যুদ্ধ নিরোধ সংক্রান্ত যাবতীয় পদক্ষেপ প্রভৃতি মানব কল্যাণকর কর্মের খতিয়ান হল ইতিহাস। এ সকল তথ্য শুধু ইতিহাসই মানব সমাজের সামনে তুলে ধরে সমাজের মানুষকে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণু করে তোলে। এভাবে ইতিহাস এক দেশ ও এক জাতির সাথে অন্যদেশ ও অন্য জাতির সংযোগের ক্ষেত্রে মৈত্রীর সোপান হিসেবে কাজ করে। সুতরাং ইতিহাস এ পদ্ধতিতেই এক রাষ্ট্রের প্রতি অন্য রাষ্ট্রের মমত্ববোধ বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদে মানুষকে দীক্ষাদান করে থাকে। এদিক থেকে আমরা বলতে পারি আন্তর্জাতিকতাবাদে দীক্ষাদান ইতিহাসের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য।
২১. বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
পদ্ধতিগত দিক দিয়ে ইতিহাস প্রামাণিক তথ্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদনে অগ্রসর হয় এবং এটি মানুষের কার্যক্রমের ধারা অনুধাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিজ্ঞান হিসেবে ইতিহাসের লক্ষ হল অতীতের বহু বিক্ষিপ্ত ঘটনা, তথ্য ও ব্যক্তির অবদানকে সময়ানুক্রমিকভাবে সন্নিবেশিত করা। এ ব্যাপারে ইতিহাসের প্রথম কাজ অতীতের বাস্তব ঘটনা ও তথ্যাদি যথারীতি অনুসন্ধান করা এবং পরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা। এদিক থেকে বলা যায়, ইতিহাস বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন বৈশিষ্ট্যের দ্বারা কর্ম সম্পাদন করে থাকে ।