কিশোর অপরাধের কারণ
অপরাধের কারণ মূলত সর্বত্র একই বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে। তবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ইতিহাসভেদে এর মাত্রাগত তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের কারণ গুলো বিধৃত করা হলো:
১. দারিদ্র্য
দারিদ্র্য কিশোর অপরাধের একটি প্রধান কারণ। দারিদ্র্য কবলিত পরিবারে কোন শিশু তার নিত্যদিনের মৌল চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না। ফলে তাদের মধ্যে কিশোর অপরাধমূলক আচরণ সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় ৬৯ শতাংশ কিশোর অপরাধী দারিদ্র্যের কারণে অপরাধ করে।
২. পারিবারিক কারণ
কিশোর অপরাধের জন্য পারিবারিক পরিবেশই অনেকটা দায়ী। কেননা পরিবার পরিমণ্ডলে সুষ্ঠুভাবে যদি কিশোরের ব্যক্তিত্বের বিকাশ না ঘটে তবে সে পরিবারের সন্তান-সন্ততি কিশোর অপরাধী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
৩. চিত্তবিনোদনের অভাব
শিশু-কিশোরেরা খুবই আমোদপ্রিয়। তারা খেলাধুলা, সঙ্গিত ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বেশ আনন্দ পায়। যে সমাজে বা যে পরিবারে চিত্তবিনোদনের অভাব পরিদৃষ্ট হয় সেখানকার শিশু-কিশোরেরা উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তাঘাটে, মাঠে-ময়দানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় এবং অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে।
কিশোর অপরাধ কি | কিশোর অপরাধ কাকে বলে |
৪. অনুকরণ ও মেলামেশার প্রভাব
শিশু-কিশোরেরা খুবই অনুকরণপ্রিয়। কৌতূহল, উদ্দীপনা আর প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা কিশোর জীবন। বস্তুত কিশোর অপরাধের জন্য তাদের অবাধ মেলামেশা এবং অনুকরণপ্রিয়তা বহুলাংশে দায়ী।
৫. অশ্লীলতার প্রভাব
যে কোন অশ্লীল আচরণ, অশ্লীল গল্প-গুজব, অশ্লীল পত্রপত্রিকা বা ছায়াছবি, অশ্লীল গানবাজনা ইত্যাদি শিশু-কিশোরদের আচরণে কুপ্রভাব ফেলতে বাধ্য। বর্তমান বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের কিশোর-কিশোরীরা ঐসব অশ্লীলতার শিকার। ফলে আমাদের সমাজে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৬. শিক্ষার অভাব
বাংলাদেশের প্রায় ৭৫% লোক অশিক্ষিত। নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোররা সাধারণত লেখাপড়া শিখতে পারে না। ফলে তারা ভালোমন্দ বুঝতে না পেরে স্বভাবতই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে।
৭. আর্থসামাজিক বৈষম্য
বাংলাদেশে প্রকট আর্থসামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান। এ বৈষম্য বিক্ষোভ ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। কোন কিশোর যখন দেখে তাদের দু’বেলা অন্নের ব্যবস্থা হয় না অথচ তারই বয়সী আর একজন রাজকীয় আরাম আয়েশে লালিতপালিত হচ্ছে, তখন তার মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা তাকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে।
৮. অসংগত আদর ও শাসন
আদর-যত্ন শিশুদের মৌলিক প্রয়োজন। কিন্তু অতি আদর ও অনাদর উভয়ই তাদেরকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। অতি আদরে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। আবার অনাদর, অবহেলা এবং অতিরিক্ত শাসনেও শিশু বিদ্রোহী এবং প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে।
৯. সামাজিক পরিবর্তন
শিল্পায়ন ও নগরায়ণ এবং বিদেশি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অনুপ্রবেশের ফলে আমাদের দেশের মানুষের চালচলন, রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শ এবং বেশভূষার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এ পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কিশোরদেরকে অপরাধপ্রবণ করে তুলছে।
১০. বংশগত প্রভাব
পিতামাতার মাধ্যমে সন্তান তার বংশের দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বংশপরম্পরায় লাভ করতে পারে। তাই দেখা যায়, অপরাধীদের বংশধর অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধপ্রবণ হয়ে থাকে।
১১. জনাকীর্ণতা
জনাকীর্ণ এলাকায় কিশোরদের চলাফেরা, গল্পগুজব এবং নানা ধরনের মেলামেশা বৃদ্ধি পায়। একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে অবাধ এবং সারাক্ষণ দলবদ্ধ জীবনযাপন করতে গিয়ে অনেক সময় কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জাগে।
১২. বিচার ব্যবস্থা ও কারাগার
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের জন্য ১৯৭৮ সালে টঙ্গীতে প্রতিষ্ঠা করা হয় কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে অল্প সংখ্যক কিশোরদের স্থান সংকুলান হয়। কিশোর অপরাধীদের বৃহৎ অংশকেই কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে বয়স্ক অপরাধীদের সাথে থেকে তারা আরো বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে।
লেবেলিং তত্ত্ব – Labelling Theory |
১৩. অপরিমিত অর্থ
শিশু-কিশোররা স্বভাবতই অপরিণামদর্শী। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা পেলে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে। অনেক পরিবারে শিশু-কিশোরদের হাতে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা দেওয়া হয়। ফলে তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে।
১৪. স্থান পরিবর্তন
যেসব কর্মজীবী পিতামাতা বার বার কর্মস্থল বা পেশা পরিবর্তন করেন তাদের সন্তান-সন্ততিরা নতুন নতুন পরিবেশের সাথে সহজে খাপখাইয়ে নিতে পারে না। ফলে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
১৫. শিক্ষাঙ্গণের পরিবেশ
বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা হানাহানি ও মারামারিতে লিপ্ত থাকে। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে শিক্ষার পরিবেশ হয়ে পড়ে কলুষিত। এ রকম অশান্ত পরিবেশ ভালো, সুবোধ এবং নিরীহ ছাত্রছাত্রীকেও অপরাধপ্রবণ করে তুলছে।
১৬. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল নয়। হরতাল, ধর্মঘট, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কাজ একটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব হরতাল ও ধর্মঘটে অর্থের বিনিময়ে শিশু-কিশোরদেরকে ‘টোকাই’ হিসেবে ব্যবহার করে ধ্বংসাত্মক কাজে ধাবিত করছে। ফলে কিশোর অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৭. সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের অভাব
সমাজে সুষ্ঠুভাবে সামাজিকীকরণ না হলে অর্থাৎ অসুস্থ মানসিকতার লোকগুলোই সমাজে অস্থিরতা ও নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
১৮. মানসিক কারণ
শিশু-কিশোররা আবেগপ্রবণ হয়। ঘৃণা, নৈরাজ্য, প্রতিশোধ স্পৃহা, অত্যধিক নির্ভরশীলতা, নিরাপত্তার অভাব তাদের মনে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে।
পরিশেষে বলা যায়, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও জনসংখ্যার চাপ আর্থসামাজিক অবস্থাকে জটিল করে তুলছে এবং কিশোর অপরাধজনিত সমস্যা একটি ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। অপরাধের জন্য কিশোরদের শাস্তি না দিয়ে কি কারণে অপরাধ করছে তার প্রতিকার করা ও উপযুক্ত শিক্ষা, উপদেশ ও পরিচালনার মাধ্যমে কিশোরদের সংশোধিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে এ সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আপনার কিশোর অপরাধের কারণ সমূহ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করলেন।