কৃষি পণ্যের বিপণন
কৃষি পণ্যের বিপণন বলতে কৃষি পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় বা বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাকে বোঝায়। এ ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন কার্যাবলি হলো পরিকল্পনা প্রণয়ন, অর্থযোগান, গুদামজাতকরণ, উৎপাদন, পরিবহন, ঝুঁকি গ্রহণ, মানোন্নয়ন, বাজার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, বিজ্ঞাপন, প্যাকেটকরণ এবং বিক্রয় প্রভৃতি নির্দেশ করে।
মি. আর. এল. কোহলস্ (R. L. Kohls)-এর মতে, “বাজারজাতকরণ হচ্ছে এরূপ এক ধরনের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ যার মাধ্যমে পণ্যদ্রব্য ও সেবার প্রবাহ উৎপাদনকারীর নিকট থেকে কোনো নির্দিষ্ট সময় এবং স্থানে, তার পছন্দমত আকারে সে পরিশোধ করতে রাজি থাকে এমন একটি দামে ভোক্তার নিকট পৌঁছান হয়।”
অর্থনীতিবিদ হ্যানসেনের (Hansen) সংজ্ঞা দ্বারা বাজারজাতকরণের সর্বশেষ মতামত টানা যায়। তাঁর মতে, বাজারজাতকরণ এরূপ একটি কার্যক্রম যা ভোক্তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন আবিষ্কার করে, সে অনুসারে পণ্য অথবা সেবা উৎপন্ন করে এবং যা চাহিদা সৃষ্টি ও চাহিদা বৃদ্ধির কাজে ব্যাপৃত।”
আদর্শ খামার কাকে বলে? আদর্শ খামারের নির্ধারক সমূহ কি কি? |
বাংলাদেশে কৃষিপণ্য বিপণনের সাথে জড়িত বিভিন্ন কার্যক্রম হলো:
(i) তথ্য সংগ্রহ, (ii) ঝুঁকি গ্রহণ, (iii) অর্থায়ন, (iv) চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন, (v) শ্রেণিবিন্যাস, (vi) গুদামজাতকরণ, (vii) পরিবহন, (vii) বাজার অনুসন্ধান, (ix) ক্রয়বিক্রয় প্রভৃতি।
কৃষিপণ্যের বাজার কাঠামো তিন প্রকার। যথা-
(i) কৃষি খামারের কাছাকাছি স্থানে-প্রাথমিক বাজার,
(ii) আড়ত বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের-মাধ্যমিক বাজার এবং
(iii) ভোক্তাদের জন্য খুচরা বিক্রেতাদের বাজার।
বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের বিপণন সমস্যা
বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের বিপণন ব্যবস্থা খুব উন্নত নয়। ফলে কৃষক তাদের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী তথা ফসল বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশে কৃষিজাত পণ্য বিপণনের সমস্যা বা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির সমস্যাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. কৃষকের দারিদ্র্য: বাংলাদেশের কৃষকরা অত্যন্ত দরিদ্র। এ দারিদ্র্যের কারণে কৃষকরা ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফসল ওঠার আগেই নামমাত্র মূল্যে তা বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হয়।
২. অনুন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা: আমাদের দেশে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। ফলে দরিদ্র কৃষকের জন্য এটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, যা বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
৩. অপ্রতুল বাজার সুবিধা: কৃষিজাত পণ্য বেশিরভাগই গ্রামীণ প্রাথমিক বাজারে কেনা-বেচা হয়। এ বাজারে ভৌত অবকাঠামো খুবই দুর্বল, তাছাড়া টোল ও চাঁদা দেওয়ার কারণে কৃষকরা পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের নিট দাম কম পায়।
৪. গুদামজাতকরণ ও সংরক্ষণের অসুবিধা: ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, বিত্তশালী ব্যবসায়ী এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও কৃষিজাতপণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে গুদাম ঘরের অভাব রয়েছে। এরূপ সংরক্ষণের অসুবিধার কারণে অনেক উদ্বৃত্ত ফসল নষ্ট হয়। ফলে কৃষকরা ফসলের মৌসুমেই কম দামে ফসল বিক্রি করে ফেলতে বাধ্য হয়।
৫. ত্রুটিপূর্ণ ওজন ও পরিমাপ: বাংলাদেশের সর্বত্র ত্রুটিপূর্ণ ওজন ও পরিমাপ ব্যবহার করা হয়। এর ফলে কৃষকরা প্রতারিত হয়।
৬. দুর্বল বাজার কাঠামো: বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলো সুসংঘটিত ও সুনিয়ন্ত্রিত নয়। মৌসুমের সময় কৃষকের নিকট থেকে মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা ফসলের মূল্যের একটি মোটা অংশ কর, খাজনা, আড়তদারি, চাঁদা ইত্যাদির নামে কেটে রাখে।
৭. বিপণন ঋণের অভাব: বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন সংরক্ষণ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু কৃষকের জন্য এরূপ ঋণের ব্যবস্থা নেই কিংবা থাকলেও তা খুবই অপ্রতুল।
৮. শিক্ষার অভাব: আমাদের দেশের কৃষকরা কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। ফলে ফটকা কারবারের জটিলতা ও বৈদেশিক বাজারের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে তারা একেবারেই অপরিচিত। অশিক্ষিত কৃষক পণ্যের তথ্য সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে।
৯. পণ্যের মান নির্ধারণে জটিলতা: দেশের সকল স্থানে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মান একরূপ নয়। ফলে কৃষিপণ্যের মান নির্ধারণের বিষয়টি কৃষি বাজারে এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে।
১০. বাজার তথ্যের অভাব: কৃষিপণ্যের দামের তথ্য রেডিও এবং খবরের কাগজের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। কিন্তু অনেক কৃষক এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অবশ্য বড় ব্যবসায়ীরা টেলিফোনের মাধ্যমে অতি সহজে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্যের দামের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
১১. দামের উত্থান-পতন: বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের দামের তীব্র ওঠানামা হয়। মৌসুমের সময় দাম কম এবং যখন কৃষকের ঘরে আর ফসল থাকে না, তখন দাম বাড়ে। দামের এরূপ উত্থান-পতনের কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১২. সরকারি নীতির অভাব: বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের বাজার সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই।
১৩. প্রতিযোগিতার অভাব: সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার অভাবে কৃষিপণ্য বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন দামে বিক্রি হওয়ার ফলে কৃষক ফসলের উপযুক্ত মূল্য পায় না।
১৪. শ্রেণিবিন্যাস ও নমুনাকরণের অভাব: কৃষিপণ্যের গুণানুসারে নমুনাকরণের সুবন্দোবস্ত না থাকার কারণে নিকৃষ্ট ও উৎকৃষ্ট পণ্য প্রায় একই দামে বিক্রি হয়। ফলে কৃষক ভালো পণ্যের ভালো দাম পায় না।
বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের বিপণন ব্যবস্থায় উপরিউক্ত ত্রুটিসমূহ পরিলক্ষিত হয়। ফলে কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং এদের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।
জীবন নির্বাহী খামার ও বাণিজ্যিক খামারের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর |