ক্রিয়াবাদ তত্ত্ব
সংস্কৃতি বিকাশে বিবর্তনবাদীদের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিয়াবাদ তত্ত্বে ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীদের আলোচনায় ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। ক্রিয়াবাদীদের মতে সামাজিক কাঠামো অপরিবর্তিত রেখেই সমাজের অভ্যন্তরে পরিবর্তন হতে পারে এবং যতটুকু সম্ভব প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই সংস্কৃতির উপাদানগুলোর পরিবর্তন ঘটে।
ক্রিয়াবাদ অনুসারে আমরা দেখতে পাই যে, সংস্কৃতি নিজস্ব কার্যক্রমের মাধ্যমে গড়ে উঠে ও বিস্তার লাভ করে। এ মতবাদে বিশ্বাসীগণ মনে করেন যে, সংস্কৃতি চুক্তি ধারা বা ব্যাপ্তির মাধ্যমে বা অনুপ্রবেশের মাধ্যমে অথবা কোন সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমেও বিকাশ ঘটে না। সামাজিক মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনে ও সুবিধার্থে সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ লাভ হয়েছে।
ক্রিয়াবাদ এর প্রধান প্রধান তাত্ত্বিক হলেন, রেডক্লিফ ব্রাউন (Radcliff Brown), ম্যালিনস্কি (Malinowski) এবং আর. টি. ওয়াল্ড (R. T. Wald)। তারা সুখেইমের সমাজ ও জীবসত্তার মধ্যকার সামঞ্জস্য সম্পর্কিত মতবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ম্যালিনস্কি তাঁর ‘A Scientific Theory of Culture and Other Essay’ এবং ‘Dynamics of Cultural Change’ গ্রন্থে রেডক্লিফ ব্রাউন তাঁর Dynamics of Culture’ গ্রন্থে এবং আর. টি. ওয়াল্ড তাঁর ‘Scientific Theory of Culture’-এ সংস্কৃতির উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ সম্বন্ধে পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরেছেন।
ম্যালিনস্কি ১৯২০ সালে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় আদিম অধিবাসীদের সমাজ। সংরক্ষণে তাঁর ভূমিকার ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, আদিম সমাজের প্রত্যেকটি প্রথা, ধারণা ও রীতির সাথে জড়িত বস্তু বা আচরণ কোন না কোন সামাজিক কর্মসম্পাদন করে।
আরও পড়ুন: বিবর্তনবাদ কি ? মর্গানের বিবর্তনের তিনটি কাল উল্লেখপূর্বক আলোচনা কর
ম্যালিনস্কি, রেডক্লিফ ব্রাউন ও আর টি ওয়ান্ডের মতে ক্রিয়াবাদ এর তিনটি বিভাগ রয়েছে; যথা :
১. জীবতাত্ত্বিক (Biological)
জীবতাত্ত্বিক ধারণাকে তারা তিনটি বৈশিষ্টো ব্যাখ্যা দান করেন, যথা: উৎপাদন, পুষ্টিসাধন ও আত্মরক্ষা। এগুলো সামাজিক কার্য প্রক্রিয়াকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে। জীবজগতে দেখা যায় প্রাণী তার অঙ্গ– প্রত্যঙ্গের ক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মরক্ষা এবং আহার সংগ্রহ করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। অর্থাৎ প্রতিটি অঙ্গের একটি নির্দিষ্ট ক্রিয়া আছে এবং সকল অঙ্গের ক্রিয়ার সমন্বয়ে জীবদেহ তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। তাঁদের মতে সমাজ দেহ সম্বন্ধে অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রযোজ্য।
২. নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (Instrumental)
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অর্থ হচ্ছে সামাজিক প্রক্রিয়াগুলো সমাজের আইন ও অর্থনৈতিক কাঠামোর দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ সমাজ বিকাশের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকল ধরনের বিপরীতমুখী বিদ্যমান শক্তিসমূহ এক সূত্রে সন্নিবেশিত হয়ে একটি সমাজব্যবস্থায় পরিণত হবে।
৩. প্রশ্নার্থক (Interrogative)
এ বিশ্লেষণের মধ্যে ধর্ম, জাদুবিদ্যা ও শিল্পকলা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় উভয়েই (ম্যালিনস্কি ও রেডক্লিফ ব্রাউন) ইতিহাসের অনুমানভিত্তিক পুনর্গঠনের মূল্যকে অস্বীকার করেন। উভয়ই প্রচলিত সামাজিক সংগঠনসমূহের পঠন–পাঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। উভয়েই সংস্কৃতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বস্তু হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছেন; উভয়েই বিশেষ বিশেষ সংগঠন ও প্রথার সামাজিক ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে ঐসব সংগঠন ও প্রথার কার্যকরী ভূমিকায় ধ্যান–ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ম্যালিনস্কি ও র্যাডক্লিফ ব্রাউন প্রায় ধর্মপ্রচারকের উৎসাহ নিয়ে পৃথিবীর আদিম উপজাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে তথ্য সংগ্রহের কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। ম্যালিনস্কি ট্রোথিয়ান্ড ও মেলানেশীয় দ্বীপপুঞ্জে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন। ম্যালিনস্কির একজন স্থানীয় বন্ধু, একজন মেলোনেশীয় দ্বীপবাসী, মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় থাকাকালে যে অনুভূতি ও কর্মকাণ্ড শুভাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়বর্গের মাঝে পরিলক্ষিত হয়েছে তার সম্পর্কে যে বিবরণী ‘Science and Religion’ তুলে ধরা হয়েছিল এখানে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত হলো, “এরা এসব অনুভূতির হাতে কি ধরা দিয়েছে? মৃত্যুর ভয়াবহতার হাতে এরা কি বন্দি হয়েছে? না। অভিভূত হয়েছে তারা সত্যিই, কিন্তু যা তাদেরকে নিয়ন্ত্রিত করছে তাহলো একটি সক্রিয় বিশ্বাস। এরা কতকগুলো ঐতিহ্য সমর্থিত ক্রিয়াকর্মে পালন করছে এবং এসবের মাধ্যমেই মৃত্যু পথযাত্রীকে রক্ষার চেষ্টা করেছে অর্থাৎ যাতে তাঁর আত্মাকে নিরাপদে পরবর্তী পৃথিবী বা পরলোকে নিয়ে যাওয়া যায় এবং যাতে সেখানে তাঁর অবস্থান সুখকর হয় সেজন্য চেষ্টা করছে।
ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক ম্যালিনোস্কি ধর্মের ইতিহাস নির্মাণ কিংবা ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্ব আবিষ্কারের কোন উৎসাহ প্রদান করেননি, বরং ধর্ম সমাজে কি ভূমিকা পালন করে বা ধর্মীয় ক্রিয়ানুষ্ঠানের সামাজিক তাৎপর্য কি? সে বিষয়ে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক আগ্রহ দেখিয়েছেন। প্রত্যেক ধর্মই জীবন ও জগতের সঙ্গে জড়িত ‘কেন‘র উত্তর দেয়, এ অর্থে ধর্মের ব্যাখ্যাদানকারীর ভূমিকা রয়েছে। ম্যালিনস্কি তাঁর ‘Magic, Science and Religion’, (New York, 1954) নামক গ্রন্থে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কিভাবে ধর্মীয় ক্রিয়ানুষ্ঠান মানুষকে হতাশা, ভয় ও চরম নৈতিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করেছে। তাঁর মতে, সংস্কৃতি ক্রিয়াশীল। তিনি সমাজের সামাজিক ব্যবস্থার সাথে বিভিন্ন অংশের সম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, মানুষের জীবতাত্ত্বিক প্রয়োজন অবশ্যই পূরণ করতে হবে। কারণ যৌনতৃপ্তি এবং এ ধরনের কাজের মাধ্যমেই সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ম্যালিনস্কির বিশ্লেষণ হতে আমরা আরো স্পষ্ট করে বলতে পারি যে, সংস্কৃতি বিকাশে পরস্পরের সাথে রক্তের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক জীবনে আশ্রয় ও উৎপাদন কৌশল ইত্যাদির মাধ্যমেই সংস্কৃতি বিকাশ লাভ ঘটে।
নৃবিজ্ঞানী রেডক্লিফ ব্রাউন তাঁর ‘Structure and Function in Primitive Society’ (London, 1952 ) নামক গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন যে, কিভাবে ক্রিয়া ও অনুষ্ঠান সামাজিক সংহতিকে রক্ষা করে। তাঁর ‘The Andaman Islanders ‘ (CUP. 1922) গ্রন্থে আন্দামানের সংস্কৃতি, রূপকথা, উপাখ্যান ইত্যাদির উপরে বিস্তৃত আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন যে, এসবের সৃষ্টি সামাজিক প্রয়োজনীয়তা থেকেই এবং সেই সাথে তিনি এসবের মূল্যায়ন করতে গিয়েও দেখিয়েছেন যে, সামগ্রিক সমাজব্যবস্থার বিকাশে নিজস্ব কৃষ্টি ও উপকথার একটি সৃজনশীল ভূমিকাও রয়েছে।
বর্তমানেও ব্রিটিশ সামাজিক নৃতত্ত্বে সংস্কৃতির বিকাশ লাভ ও সংস্কৃতির উৎপত্তির কারণ হিসেবে ক্রিয়াবাদ এর উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করছে।
সমালোচনা
অবশ্য অনেক নৃবিজ্ঞানী মনে করেন যে, সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রহণীয় মতবাদ নয়; তবে তা সর্বশেষ ধরনের মতবাদ বলা চলে।
ক্রিয়াবাদী সমাজ ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণ এ ধারণার উপর নির্ভরশীল যে সমাজে অনেকগুলো সামাজিক শক্তি বর্তমান থাকে এবং তার মধ্যকার মাত্র অল্প কয়েকটি শক্তি শুধু প্রচলিত সমাজ কাঠামোর অস্তিত্বের শর্ত। সার্বিকভাবে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও অন্যান্য উপাদান সম্বন্ধীয় প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণযোগ্য তথ্য তাতে অনুপস্থিত। সর্বজনীনভাবে ধরে নিলে সেটা বিমূর্ত ঐতিহাসিক আদর্শ হতে উদ্ভূত ঐতিহাসিক তাত্ত্বিক কাঠামোগত সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যপ্রণালি বিশ্লেষণ করতে পারে। কিন্তু সমাজের প্রকৃতি ও আর্থসামাজিক কাঠামোর কোন বিশ্লেষণ দিতে অপারগ। ক্রিয়াবাদকে অর্থনৈতিক প্রান্তিকবাদের সমাজতাত্ত্বিক প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরা যায়। পাশ্চাত্য ক্রিয়াবাদীগণ সাধারণত তাদের বিষয় নির্বাচনে সাহসী ভূমিকা পালন করে থাকেন। তারা প্রশ্নোত্তর অথবা ইস্যুর আবরণে ইতিহাসকে বর্জন করেন এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে যান। তাছাড়া সমাজ কাঠামোকে স্থির মনে করেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। নৃবিজ্ঞানী রেমন্ড কার্য (Remond Firth) Social Organization and Social Change’ পুস্তকে সমাজ পরিবর্তনের বিশ্লেষণে ক্রিয়াবাদীদের সীমারেখাটি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রবহমান সমাজের সামাজিক কাঠামো স্থির ধরে নিয়েই সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে অনুসন্ধান ও অনুশীলন চালানো উচিত।
উপর্যুক্ত আলোচিত মতবাদগুলোর ব্যাখ্যা সম্পর্কে আমরা বলতে পারি যে, এ মতবাদগুলো স্বীয় ব্যাখ্যায় সাংস্কৃতিক ঘটনাবলির একটি বিশ্লেষণ দান করতে সক্ষম এবং এদের মধ্যে সুস্পষ্ট মতপার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে।