জ্ঞাতি সম্পর্ক
প্রখ্যাত American নৃবিজ্ঞানী L. H. Morgan তাঁর জ্ঞাতি সম্পর্ক বা Kinship প্রত্যয়ে তার বৈজ্ঞানিক অবদানের জন্য চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। “Ancient Society’ গ্রন্থে তিনি Kinship কে একটি Method হিসেবে দেখিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে আদিম সমাজের প্রকৃত দিক তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ Property ownership and non-ownership, family system 4 Whole social structure কে বিশ্লেষণ করেছেন।
Robin Fox তাঁর ‘Kinship and Marriage’ গ্রন্থে বলেন, “Kinship is simply the relations between kin i.e. persons related by real, putative or fictive consanguinity.” অর্থাৎ, জ্ঞাতি সম্পর্ক বলতে কেবল আত্মীয় স্বজন বা জ্ঞাতিজনের মধ্যকার সম্পর্ককে বুঝায়। জ্ঞাতিরা ঐ সকল ব্যক্তি যারা প্রকৃতপক্ষে অনুমতিভাবে অথবা কাল্পনিকভাবে রক্ত বা জন্মসূত্রে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
Robertson তাঁর Sociology গ্রন্থে বলেন, “Kinship is a network of people related by common ancestry, adoption or marriage.” অর্থাৎ, জ্ঞাতি সম্পর্ক হচ্ছে ঐ সকল ব্যক্তির মধ্যকার এক সম্পর্কের জাল বিশেষ যারা সাধারণ পূর্বপুরুষের উত্তরসূরি হিসেবে, দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে অথবা বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ।
নৃবিজ্ঞানী Rivers বলেন, “Kinship is the social recognition of biological ties.” অর্থাৎ, জ্ঞাতি সম্পর্ক হচ্ছে জৈবিক বন্ধনের সামাজিক স্বীকৃতি।
Marvin Harris এর মতে, “Kinship is the permanent idealogy of the domestic life.”
সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, জ্ঞাতি সম্পর্ক বলতে রক্ত, বিবাহ, কল্পনা, বন্ধুত্ব দত্তক গ্রহণ ইত্যাদি বন্ধনসূত্রে আবদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যকার আত্মীয়তা সম্পর্ককে বুঝায়।
বস্তুত জ্ঞাতি সম্পর্কই হচ্ছে সমাজ কাঠামোর মূল–ভিত্তি যার উপর নির্ভর করছে পারস্পরিক সম্পর্ক বা মিথস্ক্রিয়া, মানুষের সাথে মানুষের দেনা–পাওনা, দায়িত্ব কর্তব্য বা দায় দাবির সম্পর্ক।
জ্ঞাতি সম্পর্কের প্রকারভেদ
জ্ঞাতি সম্পর্ক সমাজে চার প্রকার হতে পারে। যথা:
১. জৈবিক বা রক্ত সম্পর্কিত বন্ধন: রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে যখন আত্মীয়তার সৃষ্টি হয়, তখন তাকে বলা হয় Consanguinal relationship. এটি দু‘ধরনের হতে পারে–
ক. Lineal: যখন একজনের থেকে আর একজনের জন্ম হয়, তখন এই ধরনের সম্পর্ক Lineal বলেন। যেমন– ছেলের সাথে বাবার সম্পর্ক।
খ. Collateral: যখন দু‘জন একই জায়গায় থেকে জন্ম নেয় তখন তাদের দু‘জনের সম্পর্ককে Collateral বলা হয়। যেমন– ভাইয়ের সাথে বোনের, চাচার সাথে বাবার সম্পর্ক ইত্যাদি ।
২. বৈবাহিক বন্ধন: কোন মহিলা বা পুরুষ তাদের শ্বশুর–শাশুড়ি বা শ্বশুর– শ্বাশুড়ি পক্ষের জ্ঞাতিদের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে সম্পর্কযুক্ত। বস্তুত কোন স্বামীর কাছে স্ত্রী প্রায় ক্ষেত্রেই বৈবাহিক বন্ধনের জ্ঞাতি, রক্ত সম্পর্কসূত্রে জ্ঞাতি নয়।
৩. কাল্পনিক বন্ধন : এমন একটি বিশ্বাসে আত্মীয়তার সম্পর্ক যেখানে কোন গোত্র মনে করেন যে তারা সবাই একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে। যেমন– ধর্ম পিতা–মাতা ।
৪. কৃত্রিম বন্ধন বা প্রথাগত বন্ধন: রক্ত সম্পর্ক বা বৈবাহিক ভিত্তি ছাড়াও কৃত্রিমভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। আমাদের সমাজে অজ্ঞাত লোককে বয়সের তারতম্য বিচার করে বাবা, চাচা, ভাই ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগে সম্বোধন করার রেওয়াজ রয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার উগাণ্ডাবাসীরা অনাত্মীয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মীয় করে নেয়।
আরও পড়ুন: বিবাহ কত প্রকার ও কি কি?
বর্ণনামূলক জ্ঞাতি সম্পর্ক
মর্গান একক বিবাহ থেকে বর্ণনামূলক আত্মীয়তার ভিত্তি রচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, এ ধরনের আত্মীয়তার ব্যবস্থা ব্যক্তিগত বিয়ের কারণ। মর্গান আরো বলেন যে, যেখানেই থাকুক না কেন বর্ণনামূলক জ্ঞাতি সম্পর্ক একই রকম। এ পদ্ধতিতে সম্পর্কটা ছিল নির্দিষ্ট এবং এমন কতকগুলো শব্দ আছে যা দিয়ে আত্মীয়তা একজনকে নির্দিষ্ট করে, যেমন– ভাই, স্বামী, স্ত্রী ইত্যাদি। সেজন্য বর্ণনামূলক রক্ত সম্পর্ক দ্বারা স্পষ্টভাবে জ্ঞাতি সম্পর্ক চিহ্নিত করা যায়।
এ প্রথাকে Morgan আর্য, সেমিটিক ও উরালিয়ান পরিবারভুক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “A descriptive term refers to me specific relative.”
Morgan এর মতে, যুগল দিয়ে পরিবার আবির্ভাবের সাথে সাথে বর্ণনামূলক জাতি প্রথার উন্মেষ ঘটে। কারণ সে কার সন্তান, একজনের সাথে অন্যজনের রক্ত সম্পর্ক কি তা যুগল বিয়ে পরিবার নির্ধারণ করে দেয়। তিনি বলেন, Consanguined are discribed either by primary terms of relationships or a combination of these terms, thus making are relationship of each person specific.
শ্রেণিবিন্যাসমূলক জ্ঞাতি সম্পর্ক দ্বারা একজনের জ্ঞাতি পরিচয় স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। কারণ প্রাক্– একক বিবাহ পর্যায়ে দলগত বিবাহ থাকাতে রক্ত সম্পর্ককে নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা যায় না। মর্গান এ দু‘প্রথার জ্ঞাতি সম্পর্কের পার্থক্য নির্ণয় প্রসঙ্গে বলেন, এর একটি প্রথার ভিত্তি হলো দলগত বিয়ে এবং অন্যটি হলো একক পরিবারের উন্মেষ।
বাংলাদেশের আত্মীয়তার ভিত্তি সাধারণত বর্ণনামূলক। কোন না কোন শব্দ যদিও শ্রেণিবিন্যাসমূলক শব্দের মধ্যে পড়ে তবুও বিভিন্ন শব্দ দ্বারা উভয়কে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–মা ও বাবার বোনকে আমরা শুধু খালাম্মা না বলে ‘খালাম্মা‘ ও ‘ফুফু’- এ শব্দ দুটি প্রয়োগ করে আলাদা আলাদা করে দেখাই। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝেও এরূপ শব্দ প্রচলিত আছে। যেমন– ঠাকুরমা, মাসীমা, পিসিমা ইত্যাদি অর্থাৎ মর্গানের শ্রেণিমূলক জ্ঞাতি সম্পর্ক আমাদের সমাজে দেখা যায় না আমাদের সমাজব্যবস্থায় জ্ঞাতি সম্পর্ক হচ্ছে বর্ণনামূলক।