নৃবিজ্ঞানের শাখা
নৃতত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞানের শাখা মূলত দুটি । যথা- দৈহিক বা প্রাকৃতিক নৃতত্ত্ব (Physical Anthropology) এবং সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব (Cultural Anthropology)। প্রথমটি মানুষকে প্রাণিজগতের একটি বিশিষ্ট জীব হিসেবে পাঠ করে এবং দ্বিতীয়টির বিষয়বস্তু হলো আদিম সমাজে মানুষের আচার-আচরণ।
প্রথম শাখা আবার ভূ-তত্ত্ব, জীববিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্বের সাথে জড়িত। দ্বিতীয়টিকে মাঝে মাঝে মানব জাতিতত্ত্ব বা তুলনামূলক সমাজবিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয়। নিচে নৃবিজ্ঞানের শাখা দুটি বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
ক. দৈহিক নৃতত্ত্ব (Physical anthropology)
দৈহিক নৃতত্ত্বের বিষয় হলো কি করে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের মতো প্রাণীর উদ্ভব হলো তার অনুসন্ধান করা এবং মানুষের দৈহিক গঠন, দেশ ও কালভেদে তার দৈহিক গঠনের বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনা করা।
নৃতত্ত্ববিদগণ মানুষের দৈহিক গঠন পর্যালোচনা করতে গিয়ে দুটি বাস্তবতার কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হচ্ছে- দৈহিক ও মানসিক। মানুষের দৈহিক গঠনের মধ্য থেকেই মানসিকতার তারতম্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে; যেমন- এক বর্ণের সাথে অন্য বর্ণের, এক সম্প্রদায়ের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের পার্থক্যের ফলে মানসিকতার পার্থক্যও লক্ষ করা যায়। সমাজে এক জাতির সাথে অন্য জাতির বৈবাহিক মিলনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে তা দৈহিক নৃতত্ত্ব আলোচনা করে ।
ইউরোপীয় নৃতত্ত্ববিদগণ দৈহিক নৃতত্ত্বকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মতে, দৈহিক নৃতত্ত্ব প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেরই অংশবিশেষ। কারণ মানুষ তার দেহিক ও জৈবিক দিক থেকে জীবজগতের নিয়মে আবদ্ধ এবং মানুষের মাথার চুল, মাথা ও নাকের আকৃতি, মুখমণ্ডলের অবস্থা, চোখের বিবরণ, গায়ের রং ও দেহের উচ্চতার পরিমাপে মানুষের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়।
নৃতাত্ত্বিকগণ প্রধানত এসব দৈহিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা বর্তমান মানবজাতিকে বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। বিশেষকরে, যারা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী তাদের মতে, দৈহিক নৃতত্ত্ব হলো ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান।’ কারণ, বস্তুবাদে বিশ্বাসীগণ মানুষ ও প্রাণীর মধ্যকার গুণগত পার্থক্যের কথা অস্বীকার করেন। দৈহিক নৃতত্ত্বের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। প্রাণিজগতে মানুষের স্থান নির্ণয় করতে গিয়ে দৈহিক নৃতত্ত্ব মূলত বিবর্তনধর্মী জীববিজ্ঞান ও মানব জীববিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয়ের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছিল। কেবল জীবিত মানুষ অধ্যয়নেই এর সীমাবদ্ধতা রইল না বরং বিলুপ্ত মানবজাতি ও জীবিত মানুষের পূর্বপুরুষদের যোগসূত্র আবিষ্কারে মানব জীবাশ্ম বিজ্ঞানের পঠন-পাঠনের উপরও তত্ত্ব সম্পর্কে এবং মানবদেহের পরিমাপবিদ্যা অধ্যয়নের গুরুত্বও বেড়ে গেল। ফলে দৈহিক নৃতত্ত্বের গবেষণা ক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হতে লাগলো।
আরও পড়ুন: নৃবিজ্ঞান কি বা কাকে বলে? নৃবিজ্ঞান এর জনক কে?
আধুনিক নৃবিজ্ঞানীগণ দৈহিক নৃতত্ত্বের আরো অনেকগুলো শাখার উল্লেখ করেন; যেমন- মানুষের বংশগতি নির্ধারণে নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে সংযুক্ত করে মানব বংশগতিকে নতুনভাবে পঠন-পাঠনে গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, নৃতাত্ত্বিক বংশগতিবিদ্যা দৈহিক নৃতত্ত্বের একটি নবতর শাখা হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে।
দৈহিক নৃতত্ত্বকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এর শাখা-প্রশাখার যে ব্যাপক গবেষণা তা নৃতত্ত্বের বিষয়বস্তুকে জীববিজ্ঞান থেকে মানব জীববিজ্ঞান, জীবাশ্ম বিজ্ঞান থেকে মানব জীবাশ্ম বিজ্ঞান, মানবদেহের গঠনতত্ত্ব, মানবদেহের পরিমাপ বিদ্যা, মানব বংশগতি বিদ্যা ইত্যাদি শাখাগুলো বিস্তৃত হয়েছে।
দৈহিক নৃবিজ্ঞানে আবার তিনটি দিক রয়েছে। এগুলো হলো-
১. বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞান,
২. মনুষ্য জীববিজ্ঞান,
৩. নরদেহের পরিমাপ বিদ্যা।
নিচে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞান
মানব বিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করে প্রাণিরাজ্যে মানুষের স্থান নির্ণয় ও অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের মিল অমিল খুঁজে বের করা এ শাখার অন্যতম কাজ। এর দুটি উপবিভাগ রয়েছে-
i. মানব জীবাশ্মবিজ্ঞান: এর বিষয়বস্তু হলো প্রস্তরীভূত কংকাল, জৈবশিলা ইত্যাদি। প্রাণী ও গাছপালার ফসিল (Fossil) এর আলোচ্য বিষয়।
ii. প্রাইমেটতত্ত্ব: মানুষসহ স্তন্যপায়ী অন্যান্য নর বানর জাতীয় প্রাণী সম্পর্কে গবেষণা করে।
২. মনুষ্য জীববিজ্ঞান
এটি প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাস ও মানুষের স্থান নিরূপণ করে এবং নরগোষ্ঠীগুলো কিভাবে একে অপরের থেকে পৃথক এর কারণ বিশ্লেষণ করে বর্তমান মানুষের মধ্যে জৈবিক বিভিন্নতার প্রকৃতি আলোচনা করে। এর তিনটি উপবিভাগ রয়েছে-
i. নৃতাত্ত্বিক বংশগতি বিদ্যা: উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত জৈবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করে।
ii. কংকাল জীববিজ্ঞান: মানুষের কংকাল নিয়ে গবেষণা করে।
iii. মানব অভিযোজন বিদ্যা: প্রকৃতির সাথে মানুষের খাপখাইয়ে চলার প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে।
৩. নরদেহের পরিমাণ বিদ্যা
এ বিদ্যা নরদেহ ও তার বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গের আনুপাতিক পার্থক্য নির্ধারণ এবং বিশ্লেষণ করে। দেহের কোন অঙ্গের দৈর্ঘ্য ও গ্রন্থভেদে অন্য অঙ্গ কিরূপ হয়ে থাকে এ বিষয়ে পরিমাপ এর অন্তর্ভুক্ত।
বস্তুত দৈহিক মনুষ্য জীববিজ্ঞান প্রাণীর উৎপত্তি, বিকাশ, প্রাণিরাজ্যে মানুষের স্থান, অঙ্গ, গঠনপ্রণালি ও তার আনুপাতিক হিসাব বিশ্লেষণ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর দৈহিক বৈশিষ্ট্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে। মানুষের ক্রমবিকাশের ধারায় Missing links বা হারানো সূত্রাবলি খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই মনুষ্য জীববিজ্ঞানীর সার্থকতা নিহিত।
খ. সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান (Cultural anthropology)
সাধারণত নৃবিজ্ঞানের যে শাখায় আদিম ও প্রাক-স্বাক্ষর গোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতি সম্পর্কে অনুশীলন করা হয় তাকে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব বলা হয়। মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ যা প্রাচীন কাল হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে তা সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের আলোচ্যবিষয়।
সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের উদ্ভব ও পরিণতির কথা নিয়ে আলোচনা করে। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান বলতে বুঝায় অজৈব, সামাজিক উত্তরাধিকার (Heritage of non-biological socially transmitted traits)। মানুষ সামাজিক উত্তরাধিকার হিসেবে যেসব কলাকৌশল, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, নন্দন- চেতনা, ন্যায়বোধ ও সমাজ সংগঠন লাভ করে, নৃতত্ত্বে তাকেই বলে সংস্কৃতি। নৃতত্ত্ব বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে বিভিন্ন মানব ধারার যোগাযোগ কিভাবে ছিল, কিভাবে একের সংস্কৃতি অন্যে গ্রহণ করেছে, কিভাবে সাংস্কৃতিক জটিলতার উদ্ভব হয়েছে তার কথা আলোচনা করে।
আরও পড়ুন: নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
সংস্কৃতি সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের মৌল প্রত্যয়। সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের পরিধি খুবই ব্যাপক। নৃতত্ত্ববিদগণ সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বকে তিনটি প্রধান উপশাখায় ভাগ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে- (১) প্রত্নতত্ত্ব, (২) মানব জাতিতত্ত্ব ও (৩) ভাষাতত্ত্ব।
নিচে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. প্রত্নতত্ত্ব (Archacology): প্রত্নতত্ত্বের মাধ্যমে আমরা অতীত সমাজে মানুষের সৃজনশীল ও শৈল্পিক কার্যাবলি, তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, তাদের ভাস্কর্য ও তাদের উৎপাদিত দ্রব্য সম্বন্ধে অবগত হতে পারি। প্রত্নতত্ত্ব প্রাক-শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় ব্যাপৃত থাকে।
২. মানব জাতিতত্ত্ব (Ethnology): মানব জাতিতত্ত্বের প্রধান আলোচ্যবিষয় হলো মানুষের সামাজিক প্রক্রিয়া। এটি মানুষের অতীত ও বর্তমান সংস্কৃতির বিকাশ নিয়েও আলোচনা করে থাকে। মানব জাতিতত্ত্বে জাতির উদ্ভব ও পরিণতিকে নিয়ে আলোচনা করে থাকে। সামাজিক জীবনে আবালবৃদ্ধবনিতার পদমর্যাদা কি এবং মানুষের সামাজিক আইন, অধিকার ও উত্তরাধিকারী প্রথা, ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে বিধি-জ্ঞান ইত্যাদি মানব জাতিতত্ত্বে পাওয়া যায়।
৩. ভাষাতত্ত্ব (Linguishies): মানুষ যখন থেকে নিজের মনোভাব লিখে ব্যক্ত করতে আরম্ভ করেছে তখন থেকেই (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০) মানুষের ইতিহাসের সময় ধরা হয়। মানুষের ভাষার উৎপত্তি ও মানবসভ্যতায় ভাষার ভূমিকা অনুধাবন করাই ভাষা বিজ্ঞানীর কাজ। সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদগণ বিভিন্ন জাতির ভাষার উৎপত্তি, ভাষার পরিবর্তন ও ভাষার পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করে থাকেন।
সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বে প্রধানত তিনটি মতবাদ লক্ষ করা যায়; যথা- সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদ (Evolutionism), ব্যাপ্তিবাদ বা অনুপ্রবেশবাদ (Diffusionism) এবং ক্রিয়াবাদ (Functionalism)। সাংস্কৃতিক বিবর্তনমূলক মতবাদের অপর নাম সাংস্কৃতিক ইতিহাসমূলক মতবাদ (Cultural history) ।