প্রথা কি?
প্রথা হলো মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত রীতি ও ব্যবহার বিধি। লোকাচার ও লোকনীতি মান্য করে চলা মানবসমাজে অভ্যাসগত ক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়, একেই বলে প্রথা। অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ এর মতে, “প্রথা হলো আচরণ বিধি বা জটিল রীতির সমষ্টি।” (…… an intricate complex of usages or modes of behaviour.)
অধ্যাপক অগবার্ন ও নিমকফ এর মতানুসারে, “সামাজিক অনুমোদন এবং ধারাবাহিকতার লেবেলযুক্ত সামাজিক কার্যকে প্রথা বলা হয়।” (Customs are social habit and through repetition become the basis of an order of social behaviour.)
সমাজ অনুমোদিত মান ও জীবনধারার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে প্রথা ব্যক্তিকে বাধ্য করে। ব্যক্তির আচরণের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রথাসমূহকে যথাযথভাবে পালন করা উচিত বিবেচনা করা হয়। সুদূর অতীত থেকে এ ধারা চলে আসছে বলে প্রথার মধ্যে তিনটি উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায়; একই প্রকার পৌনঃপুনিক আচরণ সামাজিক প্রকৃতি এবং মূল্যমান। অধ্যাপক জিসবার্ট (Gisbert) প্রথার তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা:
ক. আচরণের ধারাবাহিকতা (Constant way of acting),
খ. সামাজিক প্রকৃতি (Social in character) এবং
গ. আদর্শগত মূল্যমান (Normative value).
আরও পড়ুন: সামাজিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমের ভূমিকা তুলে ধর
কিংসলে ডেভিস (Kingsley Davis) বলেন, প্রথা বলতে সেসব আচরণ বুঝায় যা বহু পুরুষ যাবৎ চলে আসছে এবং তা অনুসৃত হয় এজন্য যে তা অতীতেও অনুসৃত হতো। এর তিনটি দিক আছে- ঐতিহ্য, স্বয়ংক্রিয়তা এবং জনগণের স্বীকৃতি। ডেভিসের মতে, প্রথা নানা প্রকার আচরণের স্বীকৃতি হতে পারে; যথা: অর্থনৈতিক, পারিবারিক, ধর্মীয় এবং ভাষা সম্পর্কীয়। তিনি আরো বলেন যে, বিস্তৃত অর্থে লোকাচার (Folkways) এবং লোকনীতি (Mores) প্রথার অন্তর্গত। প্রথার পশ্চাতে আছে বহুদিনের প্রচলিত ব্যবহার ও আচরণ।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে প্রথার সামাজিক শক্তি, এর বিস্তৃত প্রচলন, এর মূল্যমান, এর বিভিন্ন দিক পরিস্ফুট হবে। প্রথার সামাজিক শক্তি সম্বন্ধে মরিস জিন্সবার্গ বলেন, ভাবাবেগের দিক থেকে প্রথা দ্বিবিধ শক্তির দ্বারা সমর্থিত।
প্রথমত, প্রথার সমর্থনে মানুষের একটি অনুভূতি বা আবেগ থাকে যা কেউ প্রথার বিপরীত আচরণ করলে তা নিন্দনীয় মনে করে। এ ভাবাবেগের মধ্যে কিছুটা যুক্তিও আছে (যদিও তা খুব স্পষ্ট নয়)। যে প্রথা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে কোন একটি পরিস্থিতিতে কিরূপ আচরণ করা যায় তা জানা যায়।
দ্বিতীয়ত, প্রথা নানাবিধ সামাজিক মনোভাবের উপর নির্ভর করে। এ মনোভাব গোষ্ঠী জীবনের উৎস।
প্রথার প্রকারভেদ
প্রথা দু’প্রকারের। প্রথমত, কতকগুলো প্রথা আছে যা ব্যক্তিগত আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। যেমন- কোন পবিত্র অনুষ্ঠানে উপযুক্ত বস্ত্রাদি পরিধান করে যাওয়া। আর এক প্রথা আছে যা সম্মিলিতভাবে অনুসৃত হয়। যেমন- সারিবদ্ধ হয়ে বাস বা রেলগাড়ির টিকেট ক্রয় করা।
প্রথাকে সাধারণত প্রতিষ্ঠিত অভ্যাসের ফল হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু মানবসমাজে এমন প্রথাও দেখা যায়, যার সাথে অভ্যাসের কোন সম্পর্ক নেই। যেমন- হিন্দু সমাজে বিধবাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, নিরামিষ খাদ্য, অলঙ্কার বর্জন সম্পর্কিত প্রথা।
প্রথাকে সামাজিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক মনে করা হয়। কারণ সমাজব্যবস্থা থেকেই প্রথার সৃষ্টি হয় এবং সভ্যতা সংস্কৃতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। প্রথার মাধ্যমেই সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পুরুষানুক্রমে অর্জিত ও সঞ্চারিত হয়।
সমাজব্যবস্থার সার্বিক বিচারে প্রথার সঙ্গে সমষ্টিগত কল্যাণ জড়িত আছে বলে মনে করা হয়। সামাজিক প্রথাসমূহ যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে সমাজজীবনে সমষ্টিগত কল্যাণ সাধিত হয়। ফলশ্রুতি হিসেবে সমাজজীবনের স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ ধারা অব্যাহত থাকে। এ কারণে সামাজিক প্রথার সঙ্গে একটা আবেগ বা আদর্শগত মূল্য আরোপিত হতে দেখা যায়। তাই প্রথা পালনের ব্যাপারে সমাজবাসীদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রবণতা বা স্বতঃস্ফূর্ত ভাব দেখা যায়।
সমাজবদ্ধ মানুষের জীবন জুড়ে প্রথাগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই সামাজিক প্রথাসমূহ সকলের নিজ্ঞান অনুমোদন লাভ করে। আর সাধারণত অবচেতন অবস্থাতেই মানুষ সামাজিক প্রথা মান্য করে চলে। এগুলো এমন গভীরভাবে সকলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে যে কোন কিছু করা বা না করার ব্যাপারে এগুলোকেই মানুষ মূল্যায়নের একমাত্র সঠিক মাপকাঠি হিসেবে ভুল করে বসে। বলা যায়, সুদূর অতীত থেকে এ ধারা চলে আসছে বলে প্রথার পিছনে সকলের নিজ্ঞান অনুমোদন সবসময় বর্তমান থাকে।
দেশ ও কালভেদে প্রথার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কালের পরিবর্তনের ফলে সামাজিক মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয় এবং তার ফলে প্রথার পরিবর্তন হতে দেখা যায়।
1 comment
[…] আরও পড়ুন: প্রথা কি বা কাকে বলে? […]
Comments are closed.