বাণিজ্যিক ব্যাংক কাকে বলে?
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বাণিজ্যিক ব্যবস্থার পত্তন ঘটে। যে ব্যাংক জনসাধারণের নিকট থেকে বিভিন্ন ধরনের আমানত গ্রহণ করে এবং ব্যবসায় বাণিজ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনে স্বল্পমেয়াদি ঋণদান করে, তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো স্বল্পমেয়াদি ঋণের কারবারি। বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা ব্যবসায় পরিচালনা করে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংজ্ঞায় অধ্যাপক গিলবার্ট (Gilbert) বলেন, “বাণিজ্যিক ব্যাংক মূলধনের এবং আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে মুদ্রার ব্যবসায়ী। ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতাদের মাঝখানে থেকে সে মধ্যস্থ ব্যবসায়ী হিসেবে এক পক্ষের কাছ থেকে খঋণ গ্রহণ করে ও অন্য পক্ষকে ঋণ দেয় এবং উভয়ের মধ্যকার পার্থক্যই হলো এর মুনাফার উৎস।”
অধ্যাপক রজার (Roger) বলেন, “যে ব্যাংক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে মুদ্রা ও মুদ্রাযোগ্য সম্পদের ব্যবসায় করে থাকে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে।” (The bank which deals with money and moneys with a view to earning profit is known as commercial bank.)
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ কি ? – আলোচনা কর |
ড. এইচ. এল. হার্ট (Dr. H. L. Hart) বলেন, “যে প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমে যাদের কাছ থেকে মুদ্রা জমা হিসাবে গ্রহণ করেছে বা চলতি হিসাবে মুদ্রা জমা রেখেছে তাদের ইস্যুকৃত চেকের মূল্য পরিশোধ করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে।” (A banker is one who in the ordinary course of business honours cheques drawn upon him by persons for and for whom he receives money on current account.)
বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফার উদ্দেশ্যেই তার কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ প্রদান করে এবং ঋণগ্রহীতাদের নিকট থেকে সুদ আদায় করে। এ সুদ আদায়ের পরিমাণ সুদ প্রদানের চেয়ে বেশি হয় বলে ব্যাংকের মুনাফা অর্জিত হয়। সুতরাং যে ব্যাংক জনগণের নিকট থেকে স্বল্প সুদের বিনিময়ে তাদের আমানত গ্রহণ করে এবং উক্ত মুদ্রা ব্যবসায়ী ও অন্যান্যদেরকে অধিকতর সুদের বিনিময়ে ঋণ দিয়ে মুনাফা অর্জন করে, তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে।
আপনারা পড়ছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক কাকে বলে ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলী সম্পর্কে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলী
বাণিজ্যিক ব্যাংক বহুমুখী কার্যাবলী সম্পাদন করে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এসব কার্যাবলী একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানাভাবে সহায়তা করে। একটি আধুনিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলীকে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে উপস্থাপন করা যায়। যথা-
ক. সাধারণ কার্যাবলী
খ. প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যাবলী
গ. সেবামূলক কার্যাবলী
ক. সাধারণ কার্যাবলী (Ordinary Functions)
১. আমানত গ্রহণ: বাণিজ্যিক ব্যাংক চলতি, সঞ্চয়ী ও স্থায়ী হিসাবের মাধ্যমে জনগণের নিকট হতে আমানত গ্রহণ করে। এ জাতীয় আমানতকৃত অর্থের সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব ব্যাংককেই বহন করতে হয়।
২. ঋণ প্রদান: বাণিজ্যিক ব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঋণ প্রদান করা। বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত হিসাবে প্রাপ্ত মুদ্রার একটি অংশ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান, গ্রাহক ও জনসাধারণকে স্বল্পমেয়াদে ঋণ হিসেবে প্রদান করে।
৩. বিনিময় বিল বাট্টাকরণ: বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবসায়ীদের বিনিময় বিলসমূহ মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই বাট্টা করে। এতে ব্যবসায়ীদের আর্থিক সংকট নিরসন হয় এবং ব্যাংকও মুনাফা অর্জন করে।
৪. আমানত সৃষ্টি: বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণগ্রহীতাকে মঞ্জুরিকৃত ঋণ নগদে প্রদান না করে ঋণগ্রহীতার নামে আমানত হিসেবে ঋণ জমা রাখে। প্রয়োজন মোতাবেক চেক উপস্থাপন করে ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা উঠিয়ে থাকে। এভাবে ঋণকৃত আমানত সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
৫. বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি: বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতকৃত মুদ্রা উত্তোলনের জন্য চেক বই সরবরাহ করে। আমানতকারীরা চেক দ্বারা টাকা উত্তোলন করে। চেক ছাড়াও হুন্ডি, ব্যাংক ড্রাফ্ট ইত্যাদির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি করে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করে।
৬. অর্থ স্থানান্তর: বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহক, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির প্রয়োজনে এক স্থান হতে অন্য স্থানে মুদ্রা স্থানান্তর করে। মুদ্রা স্থানান্তরের মাধ্যমে উভয় পক্ষই উপকৃত হয়।
২. প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যাবলি (Representative Functions)
১. গ্রাহকদের পক্ষে মুদ্রা সংগ্রহ: বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাহকদের বিনিময় বিল, চেক, অঙ্গীকারপত্র, বেতন, ভাড়া, সুদ, লভ্যাংশ, পেনসন ইত্যাদির অর্থ সংগ্রহ করে।
২. গ্রাহকদের পক্ষে মুদ্রা পরিশোধ: বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাহকদের প্রদেয় চাঁদা, ভাড়া, বিল, প্রিমিয়াম ইত্যাদি গ্রাহকদের হিসাব খাত হতে পরিশোধ করে।
৩. গ্রাহকদের শেয়ার, সিকিউরিটি ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়: বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাহকদের শেয়ার, সিকিউরিটি, বন্ড ইত্যাদি ক্রয় করে। আবার প্রয়োজনে অথবা গ্রাহকদের অনুরোধে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে।
৪. সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কার্য সম্পাদন: বাণিজ্যিক ব্যাংককে কোনো গ্রাহক মৃত্যুর পূর্বে যদি তার সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ন্যস্ত করে যায়, তাহলে উইল মোতাবেক ব্যাংক তা রক্ষণাবেক্ষণ করে।
গ. সেবামূলক কার্যাবলি (Serving Functions)
১. মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী সংরক্ষণ: বাণিজ্যিক ব্যাংক জনগণের মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী, বিল, পত্রাদি, শেয়ার, সিকিউরিটি ইত্যাদি নিরাপত্তার সাথে সংরক্ষণ করে।
২. আর্থিক অবস্থার সনদ প্রদান: বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের আর্থিক অবস্থা, লেনদেনের প্রকৃতি, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় সনদ প্রদান করে।
৩. বিভিন্ন চেকের প্রবর্তন: বাণিজ্যিক ব্যাংক ভ্রমণকারীর নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধার্থে ভ্রমণকারীর চেক ইস্যু করে। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে উপহার হিসেবে চেক প্রদান করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে প্রভূত উপকার সাধন করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আলোচনা কর |
৪. উপদেষ্টা হিসেবে সহায়তা: বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের ব্যবসায় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উপদেষ্টা হিসেবে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে।
৫. অবলেখন করে থাকে: বাণিজ্যিক ব্যাংক অনেক সময় নতুন কোম্পানির ইস্যুকৃত শেয়ার, সিকিউরিটির অবলেখকরূপে কাজ করে। অর্থাৎ আইন মোতাবেক কোম্পানির শেয়ার বিক্রয়ে ব্যর্থ হলে ব্যাংক শেয়ার বিক্রয়ের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে।
৬. তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করে: বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করে।
৭. বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন: বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদেরকে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত কাজে সহযোগিতা করে।
সুতরাং আধুনিককালে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাণিজ্যিক ব্যাংক অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিভিন্ন কাজের সুষ্ঠু সম্পাদনের মাধ্যমে দেশের ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্পোন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। অর্থনীতিবিদ আর এস রিড যথার্থই বলেছেন, “ব্যাংকসমূহ দেশের সম্পদের কেবল রক্ষণাবেক্ষণাগারই নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের আধারও বটে।”
আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক কাকে বলে ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলী সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞানলাভ করতে পেরেছেন।