বিচ্যুতি
মানবসভ্যতা পাথরের যুগ, কৃষিযুগ এবং শিল্পযুগ পেরিয়ে বর্তমান তথ্য যুগে পদার্পণ করেছে। যুগের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানবসমাজও ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। মানুষের পরস্পরের সহজাত প্রবৃত্তিগুলো সংঘর্ষমূলক হওয়ার ফলে অপরাধপ্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে। অপরাধ সামাজিক শৃঙ্খলার বিপরীত কাজ। সামাজিক পরিবেশের মাঝেই দেখা যায় অপরাধ। জনমানবহীন স্থানে অপরাধ নেই। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর থেকে বিজ্ঞানের এ যুগ পর্যন্ত গবেষণা করলে সম্ভবত এমন কোন সময় বা এমন কোন যুগ পাওয়া যাবে না যেখানে অপরাধীর অস্তিত্ব ছিল না।
“To conceive of crimeless society is practically impossible.” অর্থাৎ, অপরাধবিহীন সমাজ বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। পরিবর্তনশীল সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক কিংবা জৈবিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় এমন সব কাজ করতে পারে যা আইন ভঙ্গকারী কিংবা আইন বিরোধী হিসেবে বিবেচিত হয়। সামাজিক কার্যাবলির বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন হলো অপরাধ। অপরাধ প্রত্যয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। এর সাথে জড়িয়ে আছে সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শ, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, সাংস্কৃতিক মনোভাব, কুসংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতির বেড়াজাল। বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্র অপরাধের মাত্রা তীব্রতর রূপ লাভ করেছে এবং রাষ্ট্র ও আইনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও সংশোধন করে অপরাধ দমন ও প্রতিকারের জন্য নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বিচ্যুতির সংজ্ঞা
সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের পর থেকেই মানবগোষ্ঠীকে সমাজস্থ কিছু নিয়ম-কানুন এবং আদর্শের মানদণ্ডে পরিচালিত হতে হয়েছে। এ নিয়ম-কানুন ও আদর্শের ব্যত্যয় ঘটলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়, সমাজে নেমে আসে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত রাখা। বস্তুত সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থি আচরণই বিচ্যুতি।
সামাজিক গতিশীলতা কত প্রকার ও কি কি? |
বিচ্যুতি হলো সমাজের স্বাভাবিক এবং বাঞ্ছিত আচরণের বিরোধী বা পরিপন্থি কোন কাজ।
ডেভিড পোপেনো (David Popenoe) এর মতে, “Deviance is a behaviour that violates the social norms of a group or society. “‘ অর্থাৎ, বিচ্যুতি হলো এমন এক আচরণ যা কোন গোষ্ঠী বা সমাজের সামাজিক আদর্শকে ভঙ্গ করে।
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আর. টি. শেফার (R. T. Schaefer) তাঁর ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেছেন, “Deviance is a behaviour that violates the standards of contact or expectations of a group or society.” অর্থাৎ, বিচ্যুতি হলো সেই আচরণ যা কোন গোষ্ঠী বা সমাজের প্রত্যাশিত আচরণের মানকে ভঙ্গ করে।
রস (Ross) এর মতে, “Deviant behaviour is that behaviour which does not confirm to social expectation.” অর্থাৎ, বিচ্যুতি আচরণ হলো সেই আচরণ যা সামাজিক প্রত্যাশাকে অনুমোদন করে না।
বি. ভূষণ (B. Bhushan) তাঁর ‘Dictionary of Sociology’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “The term ‘deviance’ is used to refer to behaviour which infringes rules or the expectations of others and which attracts disapproval or punishment.” অর্থাৎ, বিচ্যুতি প্রত্যয়টি কোন আচরণকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয় যা নিয়মাবলি বা অন্যের প্রত্যাশাকে লঙ্ঘন করে এবং যা অনুমোদিত বা শাস্তির প্রতি আকৃষ্ট করে।
রবার্টসন (Robertson) এর মতে, “Deviance is a behaviour or characteristics that violate significant social norms and expectations and are negatively valued by large numbers of people in consequence.”” অর্থাৎ, বিচ্যুতি হলো এমন এক ধরনের আচরণ বা বৈশিষ্ট্য যা তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্যাশিত সামাজিক মূল্যবোধকে ভঙ্গ করে এবং যা সমাজের বহু লোক নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে।
এন্থনি গিডেন্স (Anthony Giddens) তাঁর ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেন, “Deviance may be defined as non-conformity to a given set of norms that are accepted by a significant number of people in a community or society.”
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, বিচ্যুতি হলো সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলার পরিপন্থি কাজ। কোন ব্যক্তি যখন এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করে তখন তাকে ঐ ব্যক্তির বিচ্যুত আচরণ বলে। বিচ্যুত আচরণের জন্য আইনত শাস্তির বিধান নেই বিধায় সব সমাজেই বিচ্যুত আচরণ কম-বেশি দেখা যায়। বস্তুত বিচ্যুত আচরণের জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা এবং সকলের সম্মিলিত প্রয়াস।
বিচ্যুতির বৈশিষ্ট্য
প্রত্যেক মানুষের কাছেই সমাজের প্রত্যাশা হলো সমাজের মূল্যবোধের অনুকূল আচরণ প্রদর্শন করা। কিন্তু ব্যক্তিমানুষ যখন ঐ মূল্যবোধ পরিপন্থি আচরণ প্রদর্শনে যার্থ হয় তখনই তা বিচ্যুত আচরণ হিসেবে প্রতিভাত হয়। নিম্নে বিচ্যুত আচরণের বশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. বিচ্যুতি হলো এক ধরনের আচরণ বা আচরণগত বৈশিষ্ট্য;
২. এটি হলো সমাজের মূল্যবোধ এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থিমূলক আচরণ; আচরণকে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে;
৩. সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিচ্যুত
৪. বিচ্যুত আচরণ সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত;
৫. বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য শাস্তি সবসময় নির্ধারিত নয়;
৬. সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ পরিপন্থি বিধায় এটি পরিত্যাজ্য।
বিচ্যুতির কারণ
বিচ্যুতি হলো কোন সমাজ বা গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের পরিপন্থিমূলক কাজ বা আচরণ। বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য সমাজ কাউকে বিপদগামী হিসেবে আখ্যায়িত করে কিংবা বিচ্যুতিমূলক আচরণকারী সমাজের ন্যায়-নীতি ও শৃঙ্খলার সাথে তাল মলাতে না পেরে আরো বিপদগামী হয়ে পড়ে এবং অসামাজিক বা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ প্রদর্শনে লিপ্ত হয়। কোন একটি নির্দিষ্ট কারণে বিচ্যুতি ঘটে না। এর পিছনে বানাবিধ কারণ রয়েছে। মনোচিকিৎসকগণ ও অপরাধবিজ্ঞানীরা এ ধরনের বিচ্যুতির কারণগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:
১. শারীরিক কারণ (Physical Causes),
২. মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological Causes) এবং
৩. সমাজ-সংস্কৃতিমূলক কারণ (Socio-Cultural Causes)।
নিম্নে বিচ্যুতির কারণগুলো আলোচনা করা হলো:
১. শারীরিক কারণ (Physical causes)
কোন মানুষের মধ্যে যখন শারীরিক ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হয় তখন তার আচরণের মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সে সমাজের সাথে নিজেকে খাপখাওয়াতে পারে না এবং সমাজের মূল্যবোধ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে কোন কারণে যদি ব্যক্তির শারীরিক গঠন, স্নায়ুমণ্ডল বা অন্যান্য শারীরিক বিকলাঙ্গের কারণে পূর্ণাঙ্গ বিকাশ না ঘটে তবে সে প্রত্যাশিত আচরণ প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। শারীরিক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপাদানগুলো হলো: বংশগতি, দৈহিক গঠনজনিত ত্রুটি, ক্রোমোজমের ত্রুটিজনিত বিকৃতি, জিনের ত্রুটিজনিত বিকৃতি, পরিবারের ইতিহাস বিশ্লেষণ ও যমজ সন্তান পর্যবেক্ষণ, শারীরিক অসুস্থতা, ক্লান্তি, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার।
সামাজিক গতিশীলতা বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি? |
২. মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological causes)
মনস্তাত্ত্বিক কারণেও অনেকে বিচ্যুত আচরণ করে থাকে। দুর্বল চিত্তের লোকেরা সমাজের লোকদের সাথে অনেক সময় মেলামেশা করতে সংকোচবোধ করে এবং ধীরে ধীরে বিচ্যুতির দিকে ধাবিত হয়। অনেক সময় দেখা যায়, নানারকম রোগের ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতি ‘ও মানসিক অসাম্য ঘটে থাকে, ফলে সে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে থাকে। তাছাড়া কোন পরিবারে যখন পারিবারিক কলহ চরম আকার ধারণ করে, ছেলে-মেয়েরা পিতা-মাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় তখন মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। ফলে কারণে-অকারণে তার মেজাজ রুক্ষ্ম হয় এবং বিচ্যুত আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। মনস্তাত্ত্বিক কারণের জন্য নিম্নোক্ত উপাদানগুলো; যেমন- পিতা-মাতার আদর-স্নেহের বঞ্চনা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে বঞ্চনা, ভঙ্গুর পারিবারিক কাঠামো, ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ, সামাজিক দ্বন্দ্ব-কলহ, যুদ্ধ-সংঘাত, হতাশা, চাপ ও ব্যর্থতা, অক্ষমতা, বিকলতা, অশান্তি এবং অপরিপক্বতা ইত্যাদি দায়ী।
৩. সমাজ-সংস্কৃতিমূলক কারণ (Socio-cultural causes)
মানুষ সামাজিক জীব। সুতরাং সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে তাকে সমাজস্থ নিয়ম-কানুন, আদর্শ-মূল্যবোধ ও বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয় এবং সমাজের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে সংস্কৃতি ও সভ্যতার উপাদানগুলো তাকে আত্মস্থ করতে হয়। এর মধ্য দিয়েই সে নিজেকে উপস্থাপন করে এবং সমাজের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে সমাজ আকাঙ্ক্ষিত ধারায় বেড়ে উঠে। কিন্তু নানাবিধ কারণে এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যক্তির মধ্যে তখন বিচ্যুতিমূলক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। বিচ্যুতির সমাজ-সংস্কৃতিমূলক কারণগুলোর মূল উপাদানগুলো হলো: দ্বান্দ্বিকতা, সম্পদের অসম বণ্টন, দুর্নীতি, জালিয়াতি, কর্মসংস্থানের অভাব, অপসংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িকতা, ভাষাগত ও জাতিগত দ্বন্দ্ব ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য ইত্যাদির মাপকাঠিতে যেসব কাজ বা আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অসমর্থিত তাই হলো বিচ্যুতি এবং এ বিচ্যুতির জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট কারণ এককভাবে দায়ী নয়।
1 comment
[…] বিচ্যুতি কি, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও বিচ্য… […]
Comments are closed.