বিবাহ কাকে বলে?
বিবাহটা শুধু বিবাহ নয়, বিবাহের চেয়েও অনেক বড়। সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে বিবাহটা মানুষের সঙ্গে মানুষের বাইরের সমাজের প্রতিচ্ছবি মাত্র।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বিবাহ জিনিসটা সভ্য সমাজের অন্যান্য সব ব্যাপারের মতোই প্রকৃতির অভিপ্রায়ের সঙ্গে মানুষের অভিপ্রায়ের সন্ধি স্থাপনের ব্যবস্থা। ।” বিবাহ হচ্ছে একটি কার্যপ্রণালি যার মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। মানুষ একাকী বাস করতে চায় না, একাকী বাস করা সম্ভবও নয়, সে চায় জীবনসঙ্গী। একজন পুরুষ একজন স্ত্রীলোক সঙ্গী খুঁজে বের করে একত্রে বাস করার জন্য। তারা আবার সন্তান সন্ততির স্নেহ–ভালোবাসা উপভোগ করতে চায়। এ কারণেই বিবাহের উৎপত্তি হয়। এমন পরিবারের কথা আমরা চিন্তা করতে পারি না, যেখানে বিবাহের দ্বারা পারিবারিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়নি। একজন নারী এবং একজন পুরুষের মাঝে আগামী সংসার বা পারিবারিক জীবনের সুযোগ ঘটিয়ে দেবে বিবাহ। এটি তাদের সুযোগ দেবে সন্তান প্রসবের এবং প্রতিপালনের, সুযোগ দেবে যৌন ক্ষুধার পরিসমাপ্তি ঘটানোর, হৃদয়বৃত্তি প্রকাশ করার এবং মানসিক যাতনার উপশম ঘটানোর।
মানুষ সমাজের দাবি বা প্রয়োজন উপেক্ষা করতে পারে না, সেজন্য তাকে সমাজের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রেখে কামনা–বাসনা চরিতার্থ করতে হয়। সমাজজীবনের প্রয়োজন এবং মানব বিশেষের জৈব প্রয়োজন– এই উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন করতে মানুষ পরিবার গঠন করছে বিবাহের মাধ্যমে। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ জীব প্রকৃতি ও সমাজ প্রকৃতির অভিপ্রায়ের সন্ধি স্থাপনের ব্যবস্থাকে বিবাহ বলেছেন।
সামাজিক জীবনে মানুষ স্থায়ীভাবে একজন জীবন সঙ্গিনীকে গ্রহণ করার পূর্বে তাকে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করতে হয় এবং তা সামাজিক একটি কার্যপ্রণালি দ্বারা সম্পন্ন হয়। আমরা তাকে বিবাহ বলে থাকি। মূলত এটিই হচ্ছে পরিবার গঠনের উপায়। একজন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বলেন যে, বিবাহ হচ্ছে সমাজজীবনে একটি একক বন্ধন প্রণালি।
এল. এইচ. মর্গান বলেন, “বিবাহ হচ্ছে আইনসংগত গণিকাবৃত্তি।” কিন্তু বিবাহের সংজ্ঞা বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। তবে বিবাহের প্রকৃত সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সকল সমাজবিজ্ঞানীই বিবাহ সম্বন্ধে বলেছেন যে, বিবাহ হচ্ছে সমাজের একটি কার্যপ্রণালি– যার মাধ্যমে পরিবার গড়ে উঠে।
বিবাহের সামাজিক ও ব্যক্তিগত তাৎপর্য আছে বলেই প্রত্যেক সমাজে নানা প্রকার অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে বিবাহ কার্য সম্পাদিত হয়। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী এন্ডারসন ও পার্কার বলেন, “The wedding is the recognition of the significance of marriage to societies and to individuals through the public ceremony usually accompanying it. Such a ceremony indicates the society’s control. The pageantry impresses upon the couple the importance of the commitment they are undertaking.” অর্থাৎ, বিবাহোৎসবের মাধ্যমে বিবাহের সামাজিক ও ব্যক্তিগত মূল্য সূচিত হয়। বিবাহ জিনিসটি যে কেবল ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, এ বিষয়ে যে সমাজের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আত্মীয়–কুটুম্ব ও বন্ধু– বান্ধবদের আমন্ত্রণ করে তাদের উপস্থিতিতে বিবাহকার্য সম্পাদিত হয়। তাছাড়া বিবাহোৎসবে নবদম্পতিকে পরস্পরের নিকট নানারকম অঙ্গীকার করতে হয় এবং এ অঙ্গীকারের গুরুত্ব তারা যাতে উপলব্ধি করতে পারে তার জন্য বিবাহ অনুষ্ঠানে গাড়ম্বর অথচ গুরুগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়।
রস (Ross) বিবাহকে তিনটি Concept এর সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন–
- It is sacred,
- It is social contract,
- It is highly personal, highly individualistic.
সুতরাং বিবাহ সমাজের পক্ষে যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি ব্যক্তির নিকটও বিবাহের গুরুত্ব অপরিসীম।
অনেকে মনে করেন যে, আদিম সমাজে বিবাহের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। কিন্তু তা সম্পূর্ণ গ্রহণীয় নয়। আদিম সমাজে বিবাহের বিভিন্ন রীতিনীতি বিভিন্ন পদ্ধতিতে অনুসৃত হতো। ক্রমান্বয়ে তা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন হতে চলেছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে গোষ্ঠী বিবাহ, বহুবিবাহ, একপত্নীক বিবাহ, মাতৃতন্ত্র, যৌথ পরিবার ইত্যাদি সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিচ্ছবি, বিভিন্ন সংস্কৃতিরও বটে।
আরও পড়ুন: একক পরিবার ও যৌথ পরিবারের মধ্যে পার্থক্য
এছাড়াও আমরা দেখতে পাই যে, সমাজে বিবাহ শুধু জৈবিক ক্ষুধা নিবৃত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্রমান্বয়ে তা আর্থিক লালসার মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। একদিকে যেমন বিবাহে পণ প্রথার প্রচলন শুরু হলো অন্যদিকে তেমনি একাধিক স্ত্রীকে নিয়ে পরিবার গঠন করলে তাদের দিয়ে কাজ করানো যেত। ফলে দু‘দিক থেকেই আর্থিক লাভ হতো। কিন্তু বর্তমানে সে রীতি টিকে থাকতে পারছে না– তা আর্থিক কারণেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক। দেখা যাচ্ছে যে আমাদের সমাজের কৌলীন্য প্রথা, বহুবিবাহ ইত্যাদি প্রতিক্রিয়াশীল স্তম্ভগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে কোন ভুল নেই এবং যা ভাঙছে তা ভালোর জন্যই ভাঙছে, বিশেষকরে বহুবিবাহ প্রথাতো নিশ্চয়ই।
উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে, বিবাহ হচ্ছে পরিবার গঠনের সহায়ক। পক্ষান্তরে, সামাজিক জীবনযাত্রার শুভ উদ্বোধন ঘটায় বিবাহ। অনেক সমাজে বিবাহকে মনে করা হয় একটি সামাজিক অনুষ্ঠান বলে, আবার অনেকে মনে করে বিয়ে হচ্ছে ধর্মীয় বিষয়।
সমাজজীবন কতকগুলো কার্যপ্রণালির মাঝে অতিবাহিত হয়ে থাকে। কতকগুলো রীতিনীতির মাধ্যমে সমাজজীবন গড়ে উঠেছে– বিবাহ হচ্ছে পরিবার গঠনের কার্যপ্রণালি।
কালের বিবর্তনের ফলে দেখা যাচ্ছে বিবাহের অর্থ হচ্ছে পরিবার গঠন এবং বিবাহের রকমের মাধ্যমে পরিবারের রূপ সম্পূর্ণভাবে ফুটে উঠে।
আরও পড়ুন: পরিবারের উৎপত্তি সম্পর্কে মর্গানের তত্ত্ব