বিবাহের গুরুত্ব
বিবাহ হচ্ছে সমাজজীবনের একটি একক বন্ধন প্রণালি। মানুষের সাথে মানুষের যত ধরনের সম্পর্ক রয়েছে বিবাহ তার মূল নিয়ামক। এর মাধ্যমেই মানব ও মানবীয় সম্পর্ক নির্ণীত হয়। এর মাধ্যমেই যৌন প্রবৃত্তির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং হৃদয়বৃত্তি প্রকাশ করার ও মানসিক যাতনার উপশম ঘটে। বস্তুত বিবাহকে আমরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন মানব সমাজে এর ভূমিকা বহুবিধ এবং সুগভীর। মানব সমাজে বিবাহের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো–
১. পরিবারের ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ
পরিবার প্রতিষ্ঠা করাই বিবাহের সামাজিক উদ্দেশ্য। কেবল বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমেই সমাজ কর্তৃক স্বীকৃতি রীতি অনুসারে পরিবার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সুতরাং পরিবারের ভিত্তি হিসেবে বিবাহের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এই ভূমিকা স্থায়ী ও পবিত্র। বিবাহের মাধ্যমেই মানব–মানবীর দেহজ কামনা বাসনা নিয়ন্ত্রিত হয়। নর–নারীর যৌন জীবনকে বিবাহ স্থায়ী, দৃঢ় ও পবিত্র রূপ দান করে। বিবাহের দ্বারাই সমাজে ঐক্য ও সংহতি সংরক্ষণ হয় এবং পারিবারিক জীবনে দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের সৃষ্টি হয়।
২. নবজাতকের লালনপালন ও সামাজিকীকরণ
মানব শিশু ইতর প্রাণীর মতো সহজাত প্রবৃত্তির সাহায্যে সহজে স্বাবলম্বী হতে পারে না। তাকে সমাজে যথোপযুক্ত প্রতিপালন, পরিচর্যার মাধ্যমে শিক্ষাদীক্ষা ও সামাজিকীকরণের আবশ্যকতা অনুভূত হয়। এই দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ পিতা মাতার উপরই বর্তায়।
৩. যৌন সম্পর্কের সমাজস্বীকৃত ব্যবস্থা
সুস্থ সমাজজীবনের স্বার্থে নারী– পুরুষের অবাধ যৌন আচরণ ও উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। তা না হলে পারিবারিক জীবন ও সমগ্র সমাজ জীবনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে বাধ্য। বিবাহই একমাত্র মানব মানবীর মিলনের সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত রীতি প্রদান করে।
৪. সমাজের স্থায়িত্ব ও সংহতি
সমাজের স্থায়িত্ব ও সংহতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিবাহের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহের মাধ্যমে বরপক্ষ ও কনেপক্ষ উভয়পক্ষের পরিবারের মধ্যে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং উভয় পক্ষের পরিবারের নিকট ও দূর সম্পর্কের জাতি কুটুম্বদের মধ্যে আত্মীয়তার যোগসূত্র সৃষ্টি হয়। এই সম্পর্ক সমাজের মধ্যে সম্পর্কের জাল ছড়িয়ে দেয়।
৫. সন্তানকে সমাজস্বীকৃত পিতামাতা দান
বিবাহ একটি সন্তানকে সামাজিকভাবে স্বীকৃত পিতামাতা দান করে। সমাজে অজ্ঞাত ও অস্বীকৃত পিতৃত্বের কারণে সন্তান জারজ বলে বিবেচিত হয় এবং জারজ সন্তানের গর্ভধারিণীকে নানা কলঙ্কের অবমাননা সহ্য করতে হয়। প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী Malinowski এর অভিমত অনুসারে, বিবাহ হলো “The licensing of parenthood.” অর্থাৎ পিতৃত্বের স্বীকৃতি বা অনুমোদন ।
৬. যৌন প্রবৃত্তির পরিতৃপ্তি
বিবাহ মানুষকে যৌন ক্ষুধার পরিতৃপ্তির সহজ স্বাভাবিক সুযোগ প্রদান করে। অবদমিত বা বিকৃত যৌন জীবন ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। অবদমিত যৌন বাসনার কারণে ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতা ও বিকৃতি দেখা দিতে পারে এবং তার ফল হিসেবে ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। বস্তুত মানুষের মনপ্রকৃতির পরিপূর্ণ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য বিবাহ একান্ত অপরিহার্য।
৭. সন্তান প্রজনন ও বংশগতি রক্ষা
সন্তান প্রজনন ও বংশগতি রক্ষার ক্ষেত্রে বিবাহের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিবাহের একটি বড় উদ্দেশ্য হলো সন্তান প্রজনন ও বংশগতি অব্যাহত রাখা। তাই দেখা যায়, দম্পতি মাত্রই পুত্র সন্তান কামনা করে। হিন্দুদের কাছে বিবাহের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো পুত্রসন্তান লাভ। হিন্দুদের ধর্মীয় বিধানে বলা হয় যে, পুত্রার্থে ক্রিয়াতে ভার্ষা। প্রকৃত প্রস্তাবে বিবাহিত জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো পরিবার বা বংশের ধারাবাহিকতাকে অব্যাহত রাখা।
৮. নৈতিক মূল্য
বিবাহের নৈতিক মূল্য অপরিসীম। মানবসমাজে বিবাহের বন্ধন হলো এক অত্যন্ত পবিত্র বন্ধন। এ বন্ধন নর–নারীর কামনা বাসনাকে প্রেম প্রীতি ও গভীর ভালোবাসায় পরিণত করে। বিবাহিত জীবনের মাধ্যমে পাওয়া যায় পারস্পরিক সাহচর্য ও সহানুভূতি প্রেম প্রীতি ভালোবাসা এবং সন্তানের প্রতি স্নেহ মমতা। এই সুকোমল বৃত্তিসমূহ দম্পতির দেহজ কামনা বাসনাকে বাস্তবে এক পবিত্র আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করে। এভাবে স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে এর নিবিড় আত্মিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যক্তি মানুষের আত্মোপলব্ধি ও চরম কল্যাণের পথ প্রশস্ত ও সুগম হয়।
৯. ধর্মীয় তাৎপর্য
বিবাহের ধর্মীয় তাৎপর্য অপরিসীম। ইসলাম ধর্মে বিবাহের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে “আল্লাহতালা বলিয়াছেন অর্থাৎ আমি তোমাদিগকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করিয়াছি।” অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে “যৌবন স্বাস্থ্য ও চরিত্র রক্ষার জন্য নর নারীর পরিণত বয়সে অবিলম্বে বিবাহ হওয়া একান্ত আবশ্যক।” হিন্দুধর্মে বিবাহের ত্রিবিধ উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। যথা : ধর্ম, প্রজা (সন্তান প্রজনন) এবং রতি (যৌন সম্ভোগ)।
সুতরাং বিবাহের উদ্দেশ্যর মধ্যে ধর্মই প্রধান। হিন্দুশাস্ত্রের নির্দেশ হলো বিবাহের পর স্বামী সহধমর্মিণীর সহযোগ ধর্মাচরণ ও গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করবে।
১০. স্থানান্তর (Migration)
বিবাহ Migration এর সুযোগ সৃষ্টি করে। অনেক সময় বিয়ের পর নবদম্পত্তি স্বামী বা স্ত্রীর পক্ষের কোন জ্ঞাতির বসবাসের এলাকায় নিয়ে বসতি স্থাপন করে থাকে। এর উদ্দেশ্য বিবিধ তবে তা প্রধানত অর্থনৈতিক। যেসব এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে ভূমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেখানে যদি কারো বৈবাহিক আত্মীয় থাকে তবে অন্যত্র থেকে সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে বসবাস করার সম্ভাবনা থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, বিবাহ একটি অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এর ভিত্তিতেই পরিবার গড়ে উঠে এবং মানব মানবীয় সম্পর্ক নির্ণীত হয়। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবাহ মানব জীবনে অপরিহার্য। তাই মহাত্মা গান্ধী যথার্থই বলেছেন” “Marriage is a fence that protects religion. If the fence were to be destroyed, religion is restraint, and marriage is nothing but restraint.” অর্থাৎ বিবাহ হচ্ছে ধর্মকে রক্ষাকারী বেস্টনী। এই বেস্টনি ভেঙে গেলেই ধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে। ধর্মের মূল হচ্ছে সংযম এবং বিবাহ সংযম ব্যতীত আর কিছুই নয়।
রিলেটেড আর্টিকেল
বিবাহ কাকে বলে অথবা বিবাহের সংজ্ঞা