বেকারত্ব
সাধারণ অর্থে কর্মক্ষম ব্যক্তির কর্মসংস্থানের অভাবকে বেকারত্ব বলা হয়। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষম ব্যক্তির কর্মসংস্থান না হওয়াকে বেকারত্ব বলে।
বেকারত্বের তাত্ত্বিক আলোচনায় লুইস এবং টার্নার বেকারত্বের কালকে ব্যাপ্তি ঘণ্টা বা ম্যান আওয়ারে রূপান্তরিত করে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আমাদের বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক এবং প্রণিধানযোগ্য। ‘বিজনেস কন্ডিসন্স এনালাইসিস’ গ্রন্থে লুইস এবং টার্নার বেকারত্বকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা হলো বেকারত্ব হচ্ছে সরবরাহকৃত শ্রম ও প্রকৃত কর্মসংস্থানের বিয়োগফল। উৎপাদন বেড়ে গেলে কর্মসংস্থানও বেড়ে যাবে অবশ্য যদি শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতার হারের কোন তারতম্য না ঘটে।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ সমূহ বিস্তারিত জেনে নিন |
বাংলাদেশে বেকারত্বের কারণ: সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
অধিকাংশ গবেষণা ও আলোচনায় বাংলাদেশের বেকারত্বের কারণ খুঁজতে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, বেকারত্ব ও আংশিক বেকারত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। জনসংখ্যার পরিমাণ ও মান অনুসারে সম্পদ সৃষ্টি ও ব্যবহার না হওয়ায় আমাদের দেশে বেকারত্ব ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মৌলিক অনুসন্ধানে সমাজে বেকারত্বের কারণ নির্ণয় করতে হলে বেকারত্বের প্রকৃতির উপর যেমন গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সমাজের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব আরোপ। কারণ সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনে সমাজস্থ মানুষের বস্তুগত ও অবস্তুগত সাংস্কৃতিক দিকগুলোর প্রসূত-প্রসূন সম্পর্ক রয়েছে। অনেক দেশে সম্পদের অপ্রতুলতা থাকা সত্ত্বেও সেখানকার বাস্ত তেত্তিক কর্মোন্মুখ শিক্ষাব্যবস্থা এবং দেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সঙ্গতিপূর্ণ বাস্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োগ ও প্রসার ঘটিয়ে একদিকে যেমন অর্থনীতির বুনিয়াদ শক্ত করেছেন, তেমনি দেশবাসীর কর্মসংস্থানের বিভিন্ন সূত্র উন্মোচিত করেছেন। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বেকারত্বের কারণ একদিকে যেমন জনশক্তির প্রায়োগিক পশ্চাৎগতি; অপরদিকে সম্পদ, সদিচ্ছা, স্বার্থহীনতা, কর্মক্ষমতা, আদর্শপরায়ণতা, স্বদেশকেন্দ্রিকতা এবং বাস্তবানুগ পদক্ষেপের মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল। এ প্রেক্ষিতে আমরা নিম্নে আমাদের সমাজে বিরাজমান বেকারত্বের কয়েকটি কারণ সংক্ষেপে আলোচনা করছি:
১. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি
বাংলাদেশের আয়তন, সম্পদ ও সামর্থ্যের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। মার্কস জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তাঁর শ্রম তত্ত্বের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে, জনসংখ্যাই সম্পদ এবং শ্রম হচ্ছে দেশের মানুষের উন্নতির উপাদান। স্পেংলার এর মতে, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয় এবং যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে। মার্কস ও স্পেংলারের প্রাসঙ্গিক আলোচনা এজন্য উল্লেখ করা হলো। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনো এ সকল সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হয় নি। তবে বাস্তবতায় এসব সূত্র সত্য প্রমাণিত। কৃষিনির্ভর প্রধান অর্থনীতি এবং ভূমি এদেশের প্রধান সম্পদ হওয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে গ্রাম সমাজে বেকার কৃষক, ভূমিহীন কৃষক ক্রমান্বয়ে দারিদ্র্যের ভিত্তিই গড়ে তুলেছে।
২. ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা
বাংলাদেশের কর্মক্ষম বেকার জনসংখ্যাকে দু’ভাবে ভাগ করা যেতে পারে। যথা: শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত। প্রতি বছর বাংলাদেশে কয়েক হাজার লোক উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি লাভ করছেন। কিন্তু অল্প সংখ্যকই বাস্তবক্ষেত্রে তাদের অর্জিত শিক্ষার সার্থক বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পায়। এর প্রধান কারণ ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অর্থনীতি বিকাশের সাথে এবং বাস্তব সমাজের কাঠামোগত প্রয়োজনের সাথে ক্রমান্বয়েই সংগতিহীন হয়ে পড়ছে। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।
৩. অনুন্নত ও প্রকৃতিমুখী কৃষিব্যবস্থা
বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটেছে একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু সমাজের কাঠামোগত অবস্থানে কৃষকের উন্নতি তেমন একটা হয় নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমির উপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভূমিহীনের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম রাসায়নিক সারের প্রয়োগ কৃষিব্যবস্থায় অগ্রগতির সহায়ক হয়েছে, তবুও অনেক ক্ষেত্রে ভৌগোলিক কারণে কৃষিতে এখনো প্রকৃতিমুখী থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় প্রচলিত কৃষিব্যবস্থায় বছরে ছয় থেকে নয় মাসের বেশি কৃষিকাজ থাকে না। ফলে কৃষিকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব ও মৌসুমী বেকারত্বের শিকার।
৪. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মন্থর অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার
বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নের হার খুব দ্রুত না হওয়ায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে অত্যন্ত মন্থরগতিতে। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির রদবদল, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বেসরকারি সংস্থার উন্নয়ন কর্মসূচি অনেক ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বেকার সমস্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ সমূহ বিস্তারিত জেনে নিন |
৫. কুটিরশিল্প ও বংশীয় উৎপাদন পদ্ধতির ক্রমবিলুপ্তি
বাংলার গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছিল কুটিরশিল্প ও বংশীয় উৎপাদন পদ্ধতি। বাংলার গ্রামীণ সমাজে প্রতিটি পরিবারকেন্দ্রিক উৎপাদন ও পেশা নির্ধারণ করা ছিল। উপনিবেশিক আগ্রাসন, পুঁজি অর্থনীতির বিকাশ ও বিস্তার এবং আধুনিক শিল্পকলকারখানার উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, কংসশিল্প, হস্তশিল্প, কারুশিল্পভিত্তিক পেশাজীবী মানুষ বাস্তবতার প্রতিযোগিতার সাথে মোকাবিলা করতে পারছে না। ফলে একদিকে যেমন ঘটছে বেকারত্বের সমস্যা, অপরদিকে বিলুপ্তির পথে মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের দক্ষতা ও নৈপুণ্য।
৬. মহিলাদের কর্মসংস্থানের অভাব
বাংলাদেশের সমাজে নারী মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেশিদিনের কথা নয়। গ্রামাঞ্চলে মহিলারা গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি কৃষি ও কুটিরশিল্পের কাজে নিয়োজিত ছিল এবং গ্রাম সমাজে রক্ষণশীল মূল্যবোধ এর কারণে মহিলাদের শিক্ষার প্রসার ছিল না। বর্তমানকালে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার এবং কুটিরশিল্পের বিলীয়মান অবস্থা, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব গ্রামীণ মহিলারা বেকারত্বের শিকার হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, জনসংখ্যার অব্যাহত বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অশিক্ষিত বেকারের পাশাপাশি শিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত কারণগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
2 comments
[…] […]
[…] […]
Comments are closed.