ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী
আমানতকারী যখন ব্যাংকে টাকা জমা দেয় তখন তার নগদান বইতে ব্যাংকের ঘরকে ডেবিট করে যখন ব্যাংক হতে টাকা চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করে তখন ব্যাংকের ঘরকে ক্রেডিট করে। পক্ষান্তরে আমানতকারী যখন ব্যাংকে টাকা জমা দেয় তখন ব্যাংক আমানতকারীর পাস বইতে ক্রেডিট করে আবার যখন টাকা উত্তোলন করে তখন ব্যাংক পাস বইতে ডেবিট করে।
এ অবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট দিনে নগদান বইয়ের ব্যাংকের ঘরের উদ্বৃত্ত পাস বইয়ের উদ্বৃত্তের পরিমাণ সমান হতে বাধ্য। অর্থাৎ নগদান বইয়ের ব্যাংকের ঘরে যে পরিমাণ টাকা ডেবিট উদ্বৃত্ত হবে পাস বইতে ঠিক সেই পরিমাণ টাকা ক্রেডিট উদ্বৃত্ত হবে। আবার নগদান বইয়ের ব্যাংকের ঘরে যে পরিমাণ টাকা ক্রেডিট উদ্বৃত্ত হবে ঠিক সেই পরিমাণ টাকা পাস বইতে ডেবিট উদ্বৃত্ত হবে।
সুতরাং একটি নির্দিষ্ট দিনে আমানতকারীর নগদান বইয়ের ব্যাংক ঘরের উদ্বৃত্ত ও পাস বইয়ের উদ্বৃত্ত তত্ত্বগতভাবে এক হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে নগদান বইয়ের উদ্বৃত্ত ও পাস বইয়ের উদ্বৃত্তের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। এই পার্থক্য বা গড়মিল কোনো যুক্তিসংগত কারণে বা হিসাব লিখনের ভুলত্রুটির কারণে হয়ে থাকে। এরূপ গড়মিল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনে আমানতকারীর নগদান বই এবং ব্যাংকের পাস বইয়ের উদ্বৃত্ত সমন্বয় সাধনের জন্য একটি বিবৃতি বা বিবরণী তৈরি করা হয়। একেই ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী বলে।
অতএব কোনো নির্দিষ্ট দিনে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার নগদান বইয়ের ব্যাংক ঘরের উদ্বৃত্ত এবং পাস বইয়ের উদ্বৃত্তের গড়মিলের প্রকৃত কারণ দেখিয়ে উদ্বৃত্তের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য যে বিবরণী প্রস্তুত করে তাকে ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী বলে।
খুচরা নগদান বই কাকে বলে? খুচরা নগদান বই কত প্রকার ও কি কি? |
ব্যাংক সমন্বয় বিবরণীর প্রয়োজনীয়তা
জয় নগদান বইয়ের ব্যাংকের ঘরের উদ্বৃত্তের সাথে পাস বইয়ের উদ্বৃত্তের মিল থাকা একান্ত প্রয়োজন। কেননা আমানতকারীর প্রতিটি জমা ও খরচ যেমন আমানতকারীর নগদান বইয়ের ব্যাংকের ঘরে দেখানো হয় ঠিক তেমনি ব্যাংক ও তাদের খতিয়ানে আমানতকারীর হিসাবে লেনদেনগুলো লিখে থাকে। ফলে কোনো নির্দিষ্ট দিনে নগদান বইয়ের ব্যাংকের ঘরের উদ্বৃত্ত পাস বইয়ের উদ্বৃত্তের সমান হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক সময় ঐ উদ্বৃত্ত দুটির মধ্যে বিভিন্ন কারণে অমিল হয়ে থাকে। তখন অমিলের কারণগুলো বিশ্লেষণ করে ঐ দুটি উদ্বৃত্তের সমন্বয় ঘটানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং এ কারণেই মূলত ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী তৈরি করা হয়ে থাকে।
ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী কেন তৈরি করা হয়?
ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী তৈরি করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলে। নগদান বইয়ের ব্যাংক জমার উদ্বৃত্তের সাথে পাস বইয়ের উদ্বৃত্তের যে গড়মিল থাকে তা খুঁজে বের করে সমন্বয়সাধন করা। তাছাড়া অন্য যে সকল উদ্দেশ্য সাধনের প্রয়োজনে ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী তৈরি করা হয় তা হলো-
(i) নগদান বই ও পাস বইয়ের জেরের মধ্যে গড়মিলের নির্ভুলতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী তৈরি করা হয়।
(ii) অলিখিত লেনদেনগুলো হিসাবভুক্ত করার উদ্দেশ্যে ব্যাংক সমন্বয়বিবরণী তৈরি করা হয়।
(iii) ভুল সংশোধন করার জন্যও ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী তৈরি করা হয়।
(iv) নগদান বইয়ের উদ্বৃত্ত ও পাস বইয়ের উদ্বৃত্তের গড়মিলের কারণ নির্ণয় করার জন্য ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী তৈরি করা হয়।
(v ) আমানতকারীর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যাংক সমন্বয়বিবরণী তৈরি করা হয়।
ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী প্রস্তুতের নিয়ম
ব্যাংক সমন্বয় বিবরণী প্রস্তুত করার সময় ব্যাংক হিসাব ও পাস বইয়ে লিপিবদ্ধকৃত লেনদেনগুলো মিলিয়ে দেখতে হবে। যেসব লেনদেন উভয় বইতে লিপিবদ্ধ করা হয় নাই সেগুলোর কারণেই ব্যাংক হিসাবের উদ্বৃত্ত এবং পাস বইয়ের উদ্বৃত্তের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়।
এখন উভয় হিসাব সমন্বয় করার জন্য আমরা ব্যাংক জমার উদ্বৃত্ত নিয়ে আরম্ভ করে পাস বইয়ের উদ্বৃত্তে পৌছাতে পারি। আবার পাস বইয়ের উদ্বৃত্ত নিয়ে আরম্ভ করে নগদান বইয়ের উদ্বৃত্ত পেতে পারি। ব্যাংক সমন্বয় বিবরণীী তৈরি করার দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন-
প্রথম পদ্ধতি: নগদান বইয়ের ব্যাংক জমার উদ্বৃত্ত বা পাস বইয়ের জমাতিরিক্ত নিয়ে আরম্ভ করলে যেসব কারণে পাস বইয়ের জের বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ নগদান বইতে সেগুলোর কোনো প্রভাব পড়েনি সে বিষয়গুলো যোগ করতে হবে। এরূপ বিষয়গুলো সাধারণত নিম্নরূপ-
১. চেক ইস্যু করা হয়েছে কিন্তু প্রাপক কর্তৃক ব্যাংকে উপস্থাপন করা হয়নি।
২. দেনাদার বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যাংকে সরাসরি টাকা পরিশোধ।
৩. ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত সুদ।’
৪. ব্যাংক কর্তৃক আদায়কৃত প্রাপ্ত বিলসমূহ বিনিয়োগ, লভ্যাংশ প্রভৃতি।
৫. যেসব লেনদেন নগদান বইয়ের ব্যাংক হিসাবে ক্রেডিট করা হয়েছে কিন্তু পাস বইয়ের ডেবিট করা হয়নি।
৬. যেসব লেনদেন পাস বইয়ে ক্রেডিট করা হয়েছে কিন্তু নগদান বইয়ে ব্যাংক হিসাবে ডেবিট করা হয়নি।
যেসব লেনদেন দ্বারা পাস বইয়ের উদ্বৃত্ত হ্রাস পেয়েছে অথচ নগদান বইয়ের উদ্বৃত্ত হ্রাস পায়নি সেগুলো বিয়োগ করতে হবে। এ প্রকারের লেনদেনগুলো নিম্নরূপ-
১. যেসব চেক বা বিল আদায়ের জন্য ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত তা আদায় হয়নি।
২. আদায়ের জন্যে যেসব চেক বা বিল ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে কিন্তু তা সংশ্লিষ্ট পক্ষ কর্তৃক প্রত্যাখ্যান বা অসম্মানিত হয়ে ফিরে এসেছে।
বাট্টা কি, কত প্রকার এবং নগদ বাট্টা ও কারবারি বাট্টার মধ্যে পার্থক্য |
৩. ব্যাংক কর্তৃক ধার্যকৃত খরচাবলি জমাতিরিক্ত ঋণের উপর সুদ, কমিশন প্রভৃতির জন্য পাস বইয়ে ডেবিট করা হয়েছে কিন্তু নগদান বইতে ক্রেডিট করা হয়নি।
৪. ব্যাংক ব্যবসায়ীর পক্ষে প্রদেয় বিল বিমা প্রিমিয়াম, শেয়ার তলবের টাকা প্রদান করে থাকলে তা পাস বইয়ের ডেবিট পাশে লেখা হয়েছে, কিন্তু নগদান বইয়ে ক্রেডিট করা হয়নি।
৫. যেসব লেনদেন নগদান বইয়ের ডেবিট পার্শ্বে লেখা হয়েছে, কিন্তু নগদান বইয়ের ক্রেডিট পার্শ্বে লেখা হয়নি।
৬. যেসব লেনদেন পাস বইয়ের ডেবিট পার্শ্বে লেখা হয়েছে, কিন্তু নগদান বইয়ের ক্রেডিট পার্শ্বে লেখা হয়নি।
খ) দ্বিতীয় প্রণালি: পাস বইয়ের উদ্বৃত্ত তা নগদান বইয়ের জমাতিরিক্ত নিয়ে আরম্ভ করলে প্রথম প্রণালিতে যেসব বিষয় দফা যোগ ( করা হয়েছে তা বিয়োগ করতে হবে এবং যেসব বিষয় বিয়োগ করা হয়েছে তা যোগ করতে হবে।