মূল্যবোধ কত প্রকার বা মূল্যবোধের শ্রেণীবিভাগ অনেকেরই জানা নেই। আজকের লেখায় এই গুরুত্বপূর্ণ টপিকটি তুলে ধরেছি।
মূল্যবোধের শ্রেণীবিভাগ
মূল্যবোধ হলো এক ধরনের মান বা স্ট্যান্ডার্ড, যা সমাজের মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি নির্ধারিত হয় সামষ্টিক গ্রহণযোগ্য আচরণ এবং ইথিকস তথা নৈতিকতার দ্বারা। সমাজের ভিন্নতায় মূল্যবোধের বিভিন্নতা দেখা যায়। মূল্যবোধ বিষয়টিকে বর্তমানে শুধু সামাজিক দিক থেকেই বিবেচনা করা হয় না। বরং নাগরিক ও সমাজের কার্যকরণ ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে মূল্যবোধও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। এ জন্য আধুনিক সমাজ গবেষকরা মানুষের মূল্যবোধকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করে থাকেন। গেইল এম, ইনল (Gail M. Inlaw), এডওয়ার্ড স্প্রেঙ্গার (Eduard Spranger), বি. আর, গোয়েল (B. R. Goel), পার্কার (Parker) প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীগণ মূল্যবোধকে বিভিন্নভাবে ভাগ করেছেন। যেমন-
১. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ
মানুষের যেসব চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য, গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড, আচার ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে তাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক একে অপরের মতামত প্রকাশের সুযোগ দিবে, নিজের মতামত প্রকাশ করবে। সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ, সাহস ইত্যাদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করে।
২. জাতীয় মূল্যবোধ
যেসব আচার আচরণের মধ্য দিয়ে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে সেসব আচার-আচরণের সমষ্টিকে জাতীয় মূল্যবোধ বলে। জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করা, দেশের সম্মানহানিকর কোনো কাজ করা জাতীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী। যেসব রাষ্ট্রে জাতীয় মূল্যবোধ শক্তিশালী সেসব রাষ্ট্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বেশি।
৩. সামাজিক মূল্যবোধ
সামাজিক মূল্যবোধ হলো সামাজিক শিষ্টাচার, সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, শ্রমের মর্যাদা, শৃঙ্খলাবোধ, দানশীলতা, আতিথেয়তা, আত্মত্যাগ প্রভৃতি মানবিক সুকুমার বৃত্তির সমষ্টি। সামাজিক মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণ বিচারের মানদণ্ড। সামাজিক মূল্যবোধের মাপকাঠিতে মানুষের কাজের ভালো-মন্দের বিচার করা হয়। সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের আচরণকে পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকে একটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পরিচালিত করে।
৪. রাজনৈতিক মূল্যবোধ
বর্তমানে জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত। যে কারণে বর্তমানে রাজনৈতিক মূল্যবোধকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিচার বিবেচনা করা হয়। রাজনৈতিক আদর্শ, আনুগত্য, পরমতসহিষ্ণুতা, দায়িত্বশীলতা, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সহনশীলতা, শৃঙ্খলাবোধ প্রভৃতি বিষয় রাজনৈতিক মূল্যবোধের অংশবিশেষ। ব্যক্তির রাজনৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে জাতীয় মূল্যবোধ, জাতীয় শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক মূল্যবোধ যদি গণতান্ত্রিক হয়, তবে ঐ রাষ্ট্র এবং সমাজ গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
আপনারা পড়ছেন মূল্যবোধের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে। এছাড়া আরও নিম্নোক্ত লেখাগুলো পড়তে পারেন:
মূল্যবোধ কি | মূল্যবোধ কাকে বলে | মূল্যবোধ বলতে কি বুঝায়
৫. নৈতিক মূল্যবোধ
নীতি ও উচিত-অনুচিত বোধ হলো নৈতিক মূল্যবোধের উৎস। অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধকেই মূল্যবোধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মানুষ ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করে থাকে নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা। অন্যায় থেকে বিরত থাকা এবং সত্য-মিথ্যার ভেদাভেদ মানুষ নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা নির্ধারণ করে থাকে। পরিবার, বিদ্যালয়, শিক্ষক, সমাজ প্রভৃতি থেকে মানুষ নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা পেয়ে থাকে। নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তির জীবনকে উন্নত মানে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে ইজাজ উদ্দিন আহমেদ কায়কোবাদের কথা বলা যায়। যিনি সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর নৈতিক মূল্যবোধের তাড়না থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন। উদ্ধার কাজের ৫ম দিনে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর আটকা পড়া গার্মেন্টস কর্মী শাহিনা আকতারকে উদ্ধার করতে গিয়ে কংক্রিটের বিম কাটার চেষ্টাকালে অগ্নিদগ্ধ হন। তারপর চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয় এবং সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৬. বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধ
বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধ বলতে বাস্তবিকভাবে কোনো বিষয়কে বোঝার সামর্থ্যকে বোঝায়। সমাজ বা পরিবেশ থেকে উদ্ভূত কোনো বিষয়কে যৌক্তিকভাবে গ্রহণ করার বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধের অংশ। এ মূল্যবোধ উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষ পায় এবং নিজেও অর্জন করে। সমাজের কোনো বিষয়কে যদি কেউ যৌক্তিক দৃষ্টিতে গ্রহণ না করে তখন আমরা বলি ‘পাগলামি’ করছে। অর্থাৎ তার বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধের ঘাটতি রয়েছে।
৭. শারীরিক বা বাহ্যিক মূল্যবোধ
যে মূল্যবোধ মানুষের বাহ্যিক ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলে তাই হচ্ছে শারীরিক বা বাহ্যিক মূল্যবোধ। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা বিশেষ করে প্লেটো ও এরিস্টটল উভয়েই শারীরিক বা বাহ্যিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। জার্মান দার্শনিক ও মনোবিদ এডওয়ার্ড স্প্রেঙ্গার (Eduard Spranger) অবশ্য শারীরিক বা বাহ্যিক মূল্যবোধকে সৌন্দর্যবোধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একজন ব্যক্তির পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা, সাহসিকতা, সরলতা, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি তার শারীরিক বা বাহ্যিক মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত। অনেকেই বাহ্যিক মূল্যবোধকে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন। মূল্যবোধটি অতিমাত্রায় আপেক্ষিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন চাকরিজীবী নারী এবং একজন গৃহিণী উভয়ের মধ্যে যদি যাচাই করা হয় তবে দেখা যাবে এ মূল্যবোধ সম্পর্কে দুজন দু’ধরনের ধারণা পোষণ করছে।
৮. ধর্মীয় মূল্যবোধ
ধর্মীয় ঐতিহ্য, বিশ্বাস, ধর্ম, গ্রন্থচর্চা প্রভৃতি থেকে উদ্ভূত মূল্যবোধকে ধর্মীয় মূল্যবোধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোকে পবিত্র মনে করা হয়। ধর্মবিশেষে ধর্মীয় মূল্যবোধ ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্মান করা এবং মেনে চলা প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের কর্তব্য। আবার যেকোনো ধর্মের মূল্যবোধকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া, ধর্মীয় কার্যাদি পালনে স্বাধীনতা দেওয়াও ধর্মীয় মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত।
৯. সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ
মানুষ তার ধারণকৃত সংস্কৃতি থেকে যে সকল মূল্যবোধ গ্রহণ করে সেগুলোই সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তি অথবা সমাজস্থ কোনো গোষ্ঠীর জীবন প্রণালি। যার মধ্যে আছে কীভাবে তারা পোশাক পরবে, তাদের বিবাহ রীতি এবং পারিবারিক জীবন, কার্যপ্রণালি, অনুষ্ঠানাদি এবং বিশ্রাম সম্পর্কীয় কার্যাবলি ইত্যাদি। সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত মূল্যবোধগুলো অনেক বেশি আপেক্ষিক। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলো সামাজিক প্রথা থেকেই বেশি পরিমাণে উদ্ভূত হয়। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলো মানুষের সামাজিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজের সদস্যদের মধ্যে ‘আমরা-বোধ’ (we-feeling) জাগ্রত করে সকলকে ঐক্য ও বন্ধুত্বের বন্ধনে বেঁধে ফেলে।
১০. নান্দনিক মূল্যবোধ
মানুষের কথা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার বিভিন্ন অনুষ্ঠান অংশগ্রহণের ধরণসহ প্রতিদিনের কর্মকান্ডে দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচীর চমৎকার, ইতিবাচক, আকর্ষণীয় বহিঃপ্রকাশের সমষ্টিই নান্দনিক মূল্যবোধ। নান্দনিক মূল্যবোধ মানবিক গুণাবলিকে অধিক মাত্রায় উন্নত করে।
উপরে বর্ণিত মূল্যবোধগুলো ছাড়া আরও যে সব মূল্যবোধের কথা উল্লেখ করা যায় সেগুলো হলো অর্থনৈতিক, তাত্ত্বিক, দার্শনিক, তথ্য ও প্রযুক্তিগত মূল্যবোধ।
অতএব, আপনারা মূল্যবোধের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে জানলেন। লেখাটি পড়ে উপকৃত হলে অন্যদের সাথেও শেয়ার করার অনুরোধ রইল।