সমাজবিজ্ঞানের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক – সমাজবিজ্ঞানের সূচনাকাল থেকেই সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজকে জানতে গিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বিশ্লেষণ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন। মানুষের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ, কার্যকলাপ প্রভৃতি মূলত সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিক কাঠামো, মূল্যবোধ প্রভৃতির উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। সেজন্য মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে সমাজ থেকে আলাদা করে জানা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিংবা অর্থনৈতিক কার্যাবলি সমাজে যতই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ততই তা মানুষের সমাজজীবনকে প্রভাবান্বিত করতে থাকে এবং অর্থনীতিও আবার সমাজজীবন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থাতেই সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির নিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়।
অনেকদিন পর্যন্ত অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতিকে সমাজবিজ্ঞানের প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন। সমাজের অন্য সব ঘটনা বা সামাজিক পরিস্থিতি উপেক্ষা করে কেবল অর্থনৈতিক জীবন, কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনা অর্থনীতিবিদদের বিবেচ্য বিষয় ছিল। বুনিয়াদি বা ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনীতি বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাজার সম্পর্কিত নিয়মরীতি বা সূত্র মানব প্রকৃতি নিরপেক্ষ। তাদের মধ্যে সমাজবিজ্ঞানীদের আলোচ্য সামাজিক গড়ন ও প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করে বাজারে সূত্র আবিষ্কার করা সম্ভব। আবার কোন কোন বুনিয়াদি অর্থনীতিবিদদের মতে মানুষের আচার-আচরণ পাঠ করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ তারা প্রধানত বাজার মূল্যের চরিত্র লক্ষ্য করেন এবং প্রয়োজন হলে তারা মানব সম্পর্কে সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক ধারণা লাভ করতে পারেন। যদিও কোন কোন সমকালীন ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ স্বীকার করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন যে, তাঁদের অর্থনৈতিক চিন্তা মূলত মানব সম্পর্কে কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধের উপর প্রতিষ্ঠিত; তবু একথা সত্য যে, তাঁদের মতবাদের জনক এডাম স্মিথ ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Wealth of Nations‘ (ওয়েলথ অব নেশনস) নামক বিখ্যাত গ্রন্থে তা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি।
সমাজবিজ্ঞানের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক গবেষণা করতে গিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জনক কার্ল মার্কস ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতিকে বিচার করেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের একটা ধারাবাহিক সূত্র আবিষ্কার করেন। উনিশ শতকে ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির পরবর্তী স্তরে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘Principles of Political Economy‘ নামক গ্রন্থে। এরপর নব্য ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির মূল প্রবক্তা আলফ্রেড মার্শালের প্রভাব পরবর্তীকালে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মার্শাল অর্থনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন এ বিজ্ঞান মানুষের আচার-আচরণ পাঠ করে থাকে। মার্শাল মনে করেছেন, মানুষের অর্থনৈতিক প্রবৃত্তি অর্থাৎ সুখ ও সমৃদ্ধি লাভের ইচ্ছাকে অর্থ ও বাজারের কলাকৌশল দিয়ে পরিমাপ করা যায়। উভয়টিকে আবার চাহিদা ও সরবরাহের সূত্র দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়। এভাবে মার্শাল অর্থনীতিকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে ফেলে তার পরিধিকে সীমায়িত করেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মার্শালের চাহিদা ও সরবরাহের সূত্রের যথার্থ প্রমাণ দুর্লভ।
প্রতিষ্ঠানবাদী অর্থনীতির জনক অরস্টাইন ভেবলেন ও তাঁর অনুসারীদের মতে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিফলন ঘটে তাদের আচরণের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানবাদীদের মতে অর্থনীতিকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে। কেননা অর্থনীতি বিজ্ঞান হিসেবে মানব প্রকৃতির কোন সংকীর্ণ দিককে নিয়ে চলতে পারে না। এমনকি তা মানব প্রকৃতি নিরপেক্ষ হয়েও থাকতে পারে না। প্লেটো, এরিস্টটল ও যুসিডাইসিস প্রমুখ গ্রিক পণ্ডিতেরা সমাজজীবনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবকে লক্ষ্য করেছেন। সেরূপ প্রাচীন রোমান চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত বহু মনীষী সমাজজীবনে অর্থনীতির প্রভাবকে স্বীকার করেছেন। এদের সকলকে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদের পূর্বসূরি বলা যায়। কিন্তু কার্ল মার্কস ও তাঁর সহযোগী এঙ্গেলস এর গবেষণার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদ একটা বৈজ্ঞানিক মতবাদে পরিণত হয়।
পরবর্তীকালে অনেক সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ; যেমন- ডুরখেইম, সোমবার্ট, ম্যাক্স ওয়েবার, ওপেনহাইমার, পেরেটো, সুমপিটার, তাউনি এর মতো অনেক লেখকই অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে সমাজ পরিবর্তনের একটি অংশ বা উপাদান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এদের মতে, সামাজিক ভিত্তি থেকে বিশ্লিষ্ট যে কোন ধরনের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ। এজন্য অর্থনৈতিক নিয়মের অনেক আদি ব্যতিক্রম অর্থনীতিবিদদের মানতে হতো। তাছাড়া মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ যুক্তিনির্ভর এ ধারণাও অবাস্তব। অর্থনীতিতে যা ক্ষতি বলে বিবেচিত হয়, অনেক সময় মানুষ তাঁর আদর্শের নীতিতে সেই ক্ষতি স্বেচ্ছায় মেনে নেন। অতএব, Economics Rationality বা যুক্তিসিদ্ধ অর্থনৈতিক আচরণ সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্ভব নয়। সমাজ মানুষের ঐতিহ্যগত চিন্তাভাবনা বা ধর্মীয় বিশ্বাস অর্থনৈতিক প্রয়াসকে নিঃসন্দেহে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এখানে কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ডুরখেইম সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশ্লেষণে, সমাজের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশ্লেষণে সমাজের অর্থনৈতিক দিকটার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ডুরখেইমের দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর লিখিত “The Division of Labour in Society’ নামক গ্রন্থে। তিনি দেখিয়েছেন যে, পাশ্চাত্য সমাজের অর্থনৈতিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মূলে শুধু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থই নয়, সামাজিক নিয়মকানুন এবং মূল্যবোধও এর মূলে রয়েছে। কেননা সামাজিক গোষ্ঠীর নৈতিক মূল্যবোধের দ্বারা ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয়। আর্থিক লাভ- লোকসানও সমাজ স্বীকৃত নৈতিক মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল। তাই কোন সমাজের অর্থনীতিকে জানতে হলে এর মূল্যবোধ ও লোকরীতিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সামাজিক কার্যকলাপের একটা বিশেষ দিক ছাড়া অন্য কিছু নয়। পেরেটোও ডুরখেইমের সঙ্গে অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন।
জার্মান পণ্ডিত সোমবার্ট একাধারে অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর সুবিখ্যাত বই ‘Modern Capitalism’ ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের ভিতর পার্থক্য নির্ণয় করে দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদ সমাজকাঠামোতে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এবং সামন্ত প্রদাভিত্তিক সমাজকাঠামোতে ঐতিহ্যভিত্তিক মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয়।
ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism‘ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ক্যালভিনের মতবাদকে কেন্দ্র করে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে যা ধনতন্ত্রের বিকাশে শক্তি যুগিয়েছিল। কারণ ধর্ম প্রচারক ক্যালভিন কর্মকে একটা ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্মান দান করেন। সেজন্য উদ্যমশীল মানুষের ব্যক্তিগত নিষ্ঠাবান কর্মের ফলেই পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে।
আধুনিককালেও দেখা যায়, অর্থনৈতিক জীবনের ভিন্ন ভিন্ন দিক সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানিগণ বহু আলোচনা ও গবেষণা করেছেন; যেমন- শিল্পপ্রধান সমাজের প্রকৃতি বিশ্লেষণ, নগরায়ণের সমস্যা, সমাজজীবনের উপর স্বত্ব ও স্বত্বাধিকার সম্পর্কিত রীতিনীতির প্রভাব। পক্ষান্তরে, অনেক সমাজবিজ্ঞানিগণ অর্থনীতির গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় ‘মডেল’ এর প্রয়োগ প্রবর্তন করেছেন ।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সমাজবিজ্ঞানে জ্ঞান ব্যতিরেকে অর্থনীতির আলোচনা যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি অর্থনৈতিক নিয়মসমূহ্যে ধারণা ব্যতীত সমাজবিজ্ঞানের আলোচনা মূল্যহীন।
সমাজবিজ্ঞানের সাথে অর্থনীতির পার্থক্য: সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতি এ উভয় শান্ত সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অভিন্ন নয়। স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, অনুশীলন পদ্ধতি ও বিষয়বস্তুর পরিচ আলোচনায় এ পার্থক্য সম্পর্কেও অবহিত হওয়া যায়।
প্রথমত, সমাজবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি থাকে ব্যাপক। সমাজস্থ মানুষের সামগ্রিক আলোচনা সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, অর্থনীতি সমাজও মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়েই কেবল আলোচনা করে।
দ্বিতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানকে সাধারণ বিজ্ঞান বলা হয়। অর্থনীতি হচ্ছে বিশেষীকৃত সামাজিক বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানে একটা সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে জানার প্রয়াস পায়। পক্ষান্তরে, অর্থনীতি সামাজিক মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়ে। সমাজের কাঠামোগত অবস্থা তুলে ধরে।
তৃতীয়ত, সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতি— এ দু’টি শাস্ত্রের অনুশীলন পদ্ধতি আলাদা; সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
চতুর্থত, সমাজবদ্ধ মানুষের সাধারণত সমষ্টিগত আচার-আচরণই সমাজবিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয়। কিন্তু অর্থনীতির আলোচনায় মানুষের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ ও কার্যকলাপের উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে।
পঞ্চমত, অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক দিক আছে। তাই ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসেবে অর্থনীতির তাৎপর্য অনস্বীকার্য। সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে বস্তু নিরপেক্ষ বিজ্ঞান। সমাজের ঘটনাবলির তাত্ত্বিক সূত্র বিনির্মাণে সর্বজনীন ধারণা তুলে ধরাই প্রধানত সমাজবিজ্ঞানের কাজ।
তো আপনার সমাজবিজ্ঞানের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক ও পার্থক্য জেনে গেলেন। এছাড়া আরও পড়তে পারেন:
সমাজবিজ্ঞানের সাথে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর
ইতিহাসের সাথে ভূগোলের সম্পর্ক আলোচনা কর
ইতিহাসের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর