সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা
সমাজে ব্যক্তিগত আদর্শকে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন সমধিক। শিক্ষা সামাজিক মানুষকে নানারকম কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবার সুযোগ দান করে এবং যুক্তিসংগত উপায়ে সুনির্দিষ্ট পথে চালনা করতে সহায়তা করে। শিক্ষাগত নিয়ন্ত্রণ কিশোরদের উপর আরোপিত হয়। জীবনের প্রথম পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যমে যদি নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে না উঠে তাহলে পরবর্তী জীবনে সমাজে কুলাঙ্গার হয়ে বাস করতে হয়।
সামাজিকীকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আলোচনা কর |
সমাজবিজ্ঞানিগণ শিক্ষাকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হিসেবে মনে করেন। শিক্ষা মানুষের সাথে মানুষের হৃদয়ের এমন সম্পর্কে গড়ে তোলে যা চিরন্তন সত্যের দিকে ধাবিত, সেজন্য অনেকে শিক্ষাকে আলোর সাথে তুননা করেছেন। শিক্ষা মানবমনের সংকীর্ণতা, জড়তা ও কলুষতা দূর করতে সাহায্য করে। শিক্ষার মাধ্যমে পারস্পরিক মূল্যবোধ বুঝতে চেষ্টা করে। উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে শৃঙ্খলার মাঝে ফিরিয়ে আনার বাহন হিসেবে শিক্ষা কাজ করে থাকে। নিম্নে সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা আলোচনা করা হলো:
১. সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষা
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষা হলো অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপায় বা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ব্যক্তি মানুষের মধ্যে শিক্ষা, সততা, ন্যায়-অন্যায় বোধ ইত্যাদি ধারণাকে বিকশিত করে শিক্ষার মাধ্যমে নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব, সমাজজীবনে শৃঙ্খলার মূল্য, পরার্থে স্বার্থত্যাগ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহিষ্ণুতার তাৎপর্য প্রভৃতি প্রসঙ্গে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। শিক্ষা নতুন প্রজন্মের মধ্যে গড়ে তোলে সঠিক সামাজিক ধ্যান-ধারণা ও মনোভাব। বস্তুত শিক্ষাই শিশুকে সামাজিক জীবনযাপনের উপযোগী করে গড়ে তোলে। তাই বলা যায়, Education is a broad sense from infancy to adulthood is a vital means of social control.
২. শিক্ষা আদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে
শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন করে। পূর্বে যেসব ব্যক্তিগত আচরণগুলোকে বা রীতিনীতিগুলোকে বেশি নৈতিকতা দেয়া হতো, বর্তমানে তাদের গুরুত্ব অনেকটা কমে যাচ্ছে। সাধারণত জীবনযাত্রার মান এবং পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আচরণের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে মানুষের জীবনযাত্রার মানের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তন হয়েছে সমাজ পরিবেশেরও। এ পরিবর্তনশীল সমাজ-পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানুষের মধ্যে নতুন নতুন মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করছে শিক্ষা। আর এর প্রভাবে সমাজের অনেক কুসংস্কার দূরীভূত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা সমাজের মধ্যে আদর্শ ও মূল্যবোধ স্বায়িত্ব লাভ করছে।
৩. শিক্ষা বিশ্বাস ও মনোভাবের পরিবর্তন করে
সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা, বিশ্বাস ও মনোভাবের পরিবর্তনের সাধিত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা সমাজের অভ্যন্তরে দলগত মনোভাব এবং বিশ্বাস পরিবর্তনের সহায়তা করছে। এ বিশ্বাস ও মনোভাবের দিক থেকে মানুষের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের যে পরিবর্তন হচ্ছে তা মূলত শিক্ষার প্রভাবে। অর্থাৎ শিক্ষা একান্তভাবে সামাজিক বিশ্বাস ও মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজাদর্শের উন্নতি সাধনে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে শিক্ষার স্তর কয়টি ও কী কী? |
৪. শিশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা
শিশু ছোট বেলায় অন্যান্য প্রাণীর মতো থাকে। তার আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। পরিবার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। শিশু অনেক অসামাজিক আচরণ রপ্ত করতে পারে; কাজেই যাতে সে তা না করতে পারে তার জন্য নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হয়। নানা ধরনের শিক্ষার মাধ্যমে তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
৫. ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে যেসব আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় তার বেশির ভাগই ধর্মীয় বিষয়ক নিয়ন্ত্রণ। আর এ ধর্মীয় বিষয় জানার মাধ্যমও শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে সহায়তা করে।
৬. কর্মক্ষেত্রের সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা
কর্মক্ষেত্রে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। মানুষ কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শিখে। তাকে অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে কর্মক্ষেত্রে অনেক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রের শিক্ষা মানুষকে সামাজিক বিষয়ে অনেক কিছু শেখায় যা সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ বজায় রাখতে শিক্ষার খুবই প্রয়োজন।
৭. মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা
মানুষ সমাজবদ্ধ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। মানুষ যদি সমাজবহির্ভূত কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলো কি কি? |
৮. সামাজিক ঐক্য ও সংহতি নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা
সামাজিক ঐক্য ও সংহতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং মানুষের মানসিকতাবোধ জাগ্রত করে। ফলে সমাজজীবনে সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব বোধের সৃষ্টি করে। আবার শিক্ষা ব্যবস্থার কল্যাণের মাধ্যমে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ ও নাগরিকদের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখে।
উপর্যুক্ত আলোচনায় বলা যায়, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্যতম উপায় হিসেবে শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানব সমাজে নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রগতির পথে পরিচালিত করার জন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো অত্যাধুনিক করা প্রয়োজন। বর্তমান সমাজব্যবস্থা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ পথ হারিয়ে কলুষিতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
1 comment
[…] সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা আল… […]
Comments are closed.