সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া
সামাজিকীকরণ মূলত এক ধরনের শিক্ষণ প্রক্রিয়া। যা কোন ব্যক্তিকে সমাজে বাস করার উপযোগী করে তাকে বলা হয় সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া । সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ ‘Human Animal’ বা মানব জীব থেকে ‘Human Being’ বা সামাজিক জীবে পরিণত হয়। সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো:
১. অনুকরণ (Imitation)
অনুকরণ সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। অনুকরণের মাধ্যমে মানুষ অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করে থাকে। বিশেষকরে শিশুরা খুবই অনুকরণপ্রিয়। তারা আশেপাশের যা কিছু দেখে তাই অনুকরণ করে শিখে। পরিবার থেকেই শিশুদের এ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়, পরবর্তীতে বন্ধুবান্ধব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম ইত্যাদির নিকট থেকে অনুকরণ করে অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করে থাকে। কিশোর, যুবক এবং বৃদ্ধদের ব্যবহার সাধারণত সমাজ এবং সংস্কৃতির অনুশাসনের দ্বারা পরিচালিত। সেসব ব্যবহার অনুকরণের অর্থই হলো সমাজ ও সংস্কৃতির অনুশাসনকে মেনে চলতে শেখা। যেমন- লামিয়া নামের মেয়েটি তার মায়ের মতো কাপড় পরা, হাঁটাচলা করা, কথাবার্তা বলার চেষ্টা অনুকরণেরই একটি রূপ।
আরও পড়ুন:
সামাজিকীকরণ কি বা সামাজিকীকরণ কাকে বলে?
সমাজ কাঠামো কি? সমাজ কাঠামো কাকে বলে?
সমাজ কাঠামোর উপাদান গুলো কি কি?
Miller এবং Dollard এ সম্পর্কে বলেন, “Imitation is important in maintaining discipline and conformity to the norms of our society.” অর্থাৎ, আমাদের সমাজের নিয়মনীতি ও আদর্শকে রক্ষা বা পরিচর্যার জন্য অনুকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজের বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অনুকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। সমাজের কোন মহৎ ব্যক্তি বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী কোন ব্যক্তির আচারব্যবহার সহজেই সমাজের অন্য সদস্যদের মধ্যে সঞ্চালিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে সমাজের সদস্যদের মধ্যে একধরনের আচরণগত মিল পরিলক্ষিত হয়।
২. শিক্ষণ (Learning)
শিক্ষণ হলো সামাজিকীকরণের একটি মৌল প্রক্রিয়া। এটি হলো অতীত অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের ফলে মানব আচরণের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী পরিবর্তন। শিক্ষণের মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হতে থাকে। জন্মের পর থেকেই শিশু তার পিতামাতা বা অন্য কারো কাছ থেকে সংস্কৃতির উপাদানগুলো শিখে থাকে এবং তা বংশপরম্পরায় চলতে থাকে।
সমাজ মনোবিজ্ঞানীদের মতে, চারটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত উপাদানের সাহায্যে ব্যক্তির শিক্ষণ সম্পন্ন হয়। এগুলো হলো-
ক. তাড়না (Drive),
খ. সংকেত (Cue),
গ. প্রতিক্রিয়া (Response),
ঘ. পুরস্কার (Reward).
তাড়না কোন ব্যক্তিকে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে বা কোন কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যেমন- শিশুর ক্ষুধা হলে তা নিবৃত্তির জন্য কান্নার মাধ্যমে তার চাহিদা প্রকাশ পায়। এখানে ক্ষুধা নিবৃত্তি হলো তাড়না এবং তা পরিতৃপ্তির জন্য কান্না হলো সংকেত। শিশুটির মা যদি তার কান্নার সংকেতে সাড়া দিয়ে শিশুটিকে দুধ খাওয়ায় তবে শিশুটির ক্ষুধা নিবৃত্ত হবে। অর্থাৎ সে পুরস্কৃত হয়। ফলে শিশুটি ঐ বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ প্রতিক্রিয়াটি শিখে ফেলবে।
৩. সাংস্কৃতিক দীক্ষা (Cultural Teaching)
মানুষই একমাত্র প্রাণী যার সংস্কৃতি আছে। কিছু সংস্কৃতিবান হয়েই সে জন্মগ্রহণ করে না; বরং সামাজিক পরিবেশে সে তা আয়ত্ত করে। মানব শিশু জন্মের পর থেকে পরিবার, গোষ্ঠী এবং সমাজ থেকে সাংস্কৃতিক দীক্ষা লাভ করে থাকে। সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আদর্শ, মনোভাব, বিশ্বাস এবং চেতনা ইত্যাদি তার আচরণকে প্রভাবিত করে। এভাবে জীবন চলার পথে প্রতিটি পদক্ষেপে ব্যক্তি ভাষা, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতির অন্যান্য দিক সম্পর্কে অবগত হয়ে তার ব্যবহারের সার্বিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করে এবং ক্রমে সে জৈবিক সত্তা থেকে সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যক্তির সামাজিকীকরণ উপর্যুক্ত কতকগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং এর মাধ্যমে ব্যক্তি একটি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।