সাম্য কি বা কাকে বলে?
সাম্যের সাধারণ অর্থ হচ্ছে পরস্পর সমতা ও অভিন্নতা। মানুষ জন্মগতভাবে এক ও অভিন্ন। সকল মানুষকেই সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু পৌরনীতি ও সুশাসনে এ সীমাহীন সাম্যের ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে সাম্য একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহূত হয়। কেননা সমাজে সবাই সমান নয় এবং সবাই সমান যোগ্যতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে না। প্রকৃত অর্থে সাম্য বলতে এমন এক সামাজিক পরিবেশকে বোঝায়, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করে এবং সে সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে।
উনবিংশ শতাব্দীতে সাম্য বলতে আইনের চোখে সকলের সমতা, ভোট প্রদান ও নির্বাচিত হওয়ার সমান অধিকার ও সুযোগ লাভ করাকে বোঝাত। কিন্তু আধুনিককালে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ধারণার বিকাশের সাথে সাথে সাম্যের অর্থ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সাম্য এখন দুটি অর্থ বহন করে। প্রথমত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণির বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বিলোপ সাধন। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বিকাশের পূর্ণ সুযোগ প্রদান। এ অর্থে সাম্য বলতে সুযোগ-সুবিধাদির সমতা (Equality of Opportunities) বোঝায়।
আরও দেখুন: আইনের শাসন বলতে কি | বুঝায় আইনের শাসন কি
সাম্যকে মূলত তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা যায়-
১. সাম্য বলতে সমান করে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এর অর্থ সকল ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুসারে সকল ব্যক্তিকে সমান সুযোগ প্রদান করা।
২. সাম্য বলতে বিশেষ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা না থাকাকে বোঝায়। অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রেণিবিশেষের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা না থাকার নামই সাম্য।
৩. সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকার নামই সাম্য। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সকলকে একই পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা। সাম্যের আসল অর্থ এর প্রচলিত সুযোগ-সুবিধা সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখা।
সাম্যের সংজ্ঞা
সাম্যের সাধারণ ধারণার মধ্যে যেমন ভিন্নতা দেখা যায় তদ্রুপ রাষ্ট্র দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনার মধ্যেও সাম্যের ধারণার ভিন্নতা ছিল।
অধ্যাপক লাস্কিসহ অনেক রাষ্ট্রদার্শনিক মনে করেন, ‘সাম্য হলো বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি।’ লাঙ্কির (Laski) ভাষায়, ‘সাম্য বলতে যা বোঝায় তা হলো বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি।’ (Equality means first of all the absence of special privilege.) তিনি সাম্য বিষয়টিকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সাম্যের অর্থ হলো, সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
কিন্তু আর্নেস্ট বার্কার (Ernest Barker) বলেন, ‘সাম্য বলতে সমান করার ইচ্ছা বোঝানো একটি অবান্তর নীতি।’ (Labelling is a false principle of equality.) তাঁর মতে, ‘সকলের ব্যক্তিত্ব একইভাবে কিন্তু নিজস্ব পথ ও ধরন অনুযায়ী বিকশিত হওয়ার চূড়ান্তবোধ হতেই সাম্যের ধারণাটি উৎসারিত।’
অপরদিকে, উদারনৈতিক রাষ্ট্র দার্শনিক জে. এ. কেরি (J. A. Carry) বলেন, ‘সাম্যের ধারণায় আইনের চোখে সকলের সমান হওয়ার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে।’ (It has insisted that individuals should be equal before the law.) অর্থাৎ তিনি সাম্য বলতে আইনের চোখে সমতার বিষয়টিকে বুঝিয়েছেন।
আরনল্ড ব্রেকট (Arnold Brecht) তাঁর ‘The Political Theory’ গ্রন্থে বলেন, ‘সবশ্রেণির মানুষের সাথে সমান আচরণই হলো সাম্য এবং এটাই হলো ন্যায়বিচারের মূলকথা।’
ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (Gandhi) মতানুসারে, ‘স্বাধীনতার অর্থ বিধি-নিষেধের অনুপস্থিতি নয় বরং স্বাধীনতা গড়ার মধ্যেই এটা নিহিত।’ (Liberty does not mean the absence of restraint but it lies in development of liberty.)
লেনিন (Lenin) এর মতে, ‘সমাজের এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণির শোষণের সকল সম্ভাবনার সম্পূর্ণ ধ্বংসই প্রকৃত সাম্য।’ (There can be no real, actual equality until all possibility of exploitation of one class by another has been tolally destroyed.)
জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, ‘সবার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানই হলো সাম্য।’ (Equality means adequate opportunities are to be laid open to all.)
আরও দেখুন: মানুষ আইন মান্য করে কেন | আইন মান্য করার কারণ সমূহ লিখ
বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় সাম্য বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। সমাজব্যবস্থা স্থবির নয়; এটি গতিশীল। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে সাম্যের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে সাম্যের ধারণা ছিল একরূপ; আবার দাস সমাজে সাম্যের ধারণা হয়ে যায় ভিন্নতর। তারপর পুঁজিবাদী সমাজে অবাধ প্রতিযোগিতা দেখা দিলে সাম্যের ধারণা আরও পাল্টে যায়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাধীনে অর্থনৈতিক সাম্য পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত না হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যের অনুকূল পরিবেশ রচিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাম্যের ধারণার ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। এ ধরনের সমাজে অর্থনৈতিক সাম্যই প্রকৃত সাম্য বলে বিবেচিত। এ সমাজে প্রতিযোগিতার কোনো স্থান নেই; উৎপাদনের সম- বণ্টনই হলো সাম্য।
গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ‘সুযোগের সমতা’ সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে সাম্য। এতে অর্থনৈতিক সাম্যের চেয়ে রাজনৈতিক সাম্যের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়।
1 comment
[…] আরও দেখুন: সাম্য কি | সাম্য কাকে বলে | সাম্যের সংজ্… […]
Comments are closed.